বেশিরভাগ পারিবারিক-সামাজিক সমস্যা সৃষ্টির কারণ হয় জমিজমা। এই জমিজমা নিয়ে মানুষ যেন দুয়ারে দুয়ারে না ঘুরে, ভোগান্তিতে না পড়ে সেজন্যই অনলাইন ভূমি সেবার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
বুধবার (৮ সেপ্টেম্বর) গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি ভূমি ব্যাংক ও ডাটা ব্যাংকের উদ্বোধনের সময় এ কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০১৩ সালে বিএনপি জামাতের আগুন সন্ত্রাসের সময় দেশের অনেক ভূমি অফিসও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তারা
মানুষের জন্য রাজনীতি করেনা, অর্থের জন্য রাজনীতি করে।
এসময় ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী, ভূমি সচিব মোস্তাফিজুর রহমানসহ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, ভূমি মন্ত্রণালয় ও তার অধীনস্থ
বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
‘তাদের এই ধ্বংসযযজ্ঞ আমরা দেখেছি। আসলে বিএনপি-জামায়াত এরা তো আর মানুষের জন্য কাজ করে না। ক্ষমতাটা অবৈধভাবে দখলকারীর হাতে দিয়ে একটা মিলিটারি ডিক্টেটরের হাতে তৈরি করা এ সংগঠন। কাজেই মানুষের প্রতি এদের কোনো দায়িত্ববোধও নেই, দেশের জন্যও নেই। ক্ষমতা আর ক্ষমতায় থেকে টাকা বাড়ানো, জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাস-দুর্নীতি এটাই তাদের কাজ এবং সেটাই তারা করেছে।’
দোরগোড়ায় সেবা পৌঁছে দেয়াই লক্ষ্য
সাধারণ মানুষ যেন কোনো ভোগান্তি ছাড়াই সরকারি বিভিন্ন সেবা ঘরে বসেই পায় তা নিশ্চিত করাই ডিজিটাল বাংলাদেশের লক্ষ্য বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, ‘দ্বিতীয় দফায় যখন আমরা ২০০৯ এ সরকার গঠন করি তার আগে ২০০৮ এর নির্বাচনে আমরা আমাদের ইশতেহারে ঘোষণা দিয়েছিলাম ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তুলব। ডিজিটাল বাংলাদেশ অর্থাৎ প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে সেবাটা মানুষের দোড়গোড়ায় পৌছে দেয়া এবং মানুষের জীবনটা সহজ করা।
‘দুর্নীতি, অনিয়ম দূর করা—এটাই ছিল আমাদের লক্ষ্য। সেদিকে লক্ষ্য রেখেই আমরা বিভিন্ন পদক্ষেপ নিই এবং ভূমি ব্যবস্থাপনাটাকে ডিজিটাইজড করে মানুষের কাছে সেবাটা পৌঁছে দেয়ার জন্য আর মানুষের অধিকার সুরক্ষিত করবার জন্য আমরা বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছিলাম।’
সরকারপ্রধান বলেন, ‘আমাদের সরকারের নির্বাচনি ইশতেহারে যে রূপকল্প-২০২১ আমরা ঘোষণা দিয়েছিলাম, আমরা একটি সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনাই নিয়েছিলাম। ২০২১ এর মধ্যে বাংলাদেশ কেমন বাংলাদেশ হবে তারই একটি দিকনির্দেশনা আমরা দিয়েছিলাম। পরবর্তীতে ২০৪১ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ কীভাবে তৈরি হবে আমরা সেই প্রেক্ষিত পরিকল্পনাও ইতিমধ্যে প্রণয়ণ করেছি।
‘এতে আমদের লক্ষ্য হচ্ছে শতভাগ মিউটেশন কার্যক্রম যেন সম্পন্ন হয় এবং বাংলাদেশের ভূমি ব্যবস্থাপনা যেন সম্পূর্ণ ডিজিটাইজড হয়। কারণ মানুষ যে খামোখা হয়রানির শিকার না হয়, মানুষকে যেন ভোগান্তির শিকার না হতে হয়, দুয়ারে দুয়ারে ঘুরে বেড়াতে না হয়, সেদিকে লক্ষ্য রেখেই ভূমি সেবাটা যেন হাতের মুঠোয় পায়, সে ব্যবস্থাটাই আমরা করতে চেয়েছি। কাজেই হাতের মুঠোয় ভূমি সেবা নিশ্চিত করতে অনলাইনে খতিয়ান সংগ্রহ, উত্তরাধিকার ক্যালকুলেটর, অনলাইন ডাটাবেজসহ ভূমি সেবার সব ক্ষেত্রে অধিকতর ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘অনলাইনে খতিয়ান সংগ্রহ সিস্টেম বাস্তবায়ন হচ্ছে। এতে ঘরে বসেই সহজেই মানুষ তাদের জমির পর্চা পাচ্ছে। এতে তারা খুবই খুশি। সারা বাংলাদেশে প্রায় ৪ কোটি ৯৪ লাখ ডিজিটাইজড খতিয়ান নিয়ে তৈরি করা হয়েছে ভার্চুয়াল রেকর্ড রুম। এই রুম থেকে যে কেউ বিনা পয়সায় তার কাঙ্ক্ষিত খতিয়ান সংগ্রহ করতে পারবে।
‘আর যারা ঘরে বসে কম্পিউটার ব্যবহার করে করতে পারবে না, তাদের জন্য ডিজিটাল সেন্টার করে দেয়া হয়েছে। সেখানেও তারা সেই সেবাটা নিতে পারেন। তাদের জন্য সেই সুযোগটাও আমরা তৈরি করে দিয়েছি। প্রত্যেকটা এলাকায় যেমনটা করা হয়েছে আবার প্রত্যেক পোস্ট অফিসেও করা হয়েছে, সেখান থেকেই মানুষ সেই সেবাটা নিতে পারেন।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘ভূমি ব্যবস্থাপনাকে ডিজিটাইজড করতে তিনটি প্রকল্প নেয়া হয়েছে, ভূমি ব্যবস্থাপনা অটোমেশন প্রকল্প, ডিজিটাল পদ্ধতিতে ভূমি জরিপ করার জন্য ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তরে শক্তিশালীকরণ প্রকল্প এবং মৌজা ও ব্লকভিত্তিক ভূমি জোনিং প্রকল্প।
‘এটা এখন পর্যন্ত যতটুকু হয়েছে, আগামীতে সম্পূর্ণভাবে বাস্তবায়িত হবে। এই কাজগুলো শেষ হলে আমি মনে করি বাংলাদেশের জন্য একটি আমূল পরিবর্তন আসবে। মানুষও প্রযুক্তি ব্যবহার করে তার সেবাটা পাবে।’
তিনি বলেন, ‘যেকোনো একজন জমির মালিককে ভূমি উন্নয়ন কর প্রদানের জন্য ইউনিয়ন ভূমি অফিস পর্যন্ত যেতে হয়। কিন্তু আজকের যে পদ্ধতি তাতে অনলাইনেই দিতে পারবেন। আর এখন তো মোবাইল ফোন সকলেরই হাতে। আমরা শুধু মুখেই বলিনি; কাজেও সেটা বাস্তবায়ন করেছি। ভূমি কর প্রদানের জন্য আবশ্যিকভাবে ভূমি অফিস পর্যন্ত যাওয়ার প্রয়োজন হয় না। ডিজিটালাইজড পদ্ধতিতে তিনি কর পরিশোধ করতে পারেন।
‘দেশে-বিদেশে যেখানেই থাকেন, সেখান থেকেই সেটা করতে পারবেন। সে সুযোগটা সৃষ্টি করা হয়েছে। ঘরে বসেই যেন ভূমির মালিক উন্নয়ন কর পরিশোধ করতে পারেন, তার জন্য বাস্তবায়ন করা হচ্ছে অনলাইনে ভূমি উন্নয়ন কর পরিশোধের ডিজিটাল পদ্ধতি। এর মাধ্যমে মানুষের ভোগান্তিও কমে যাবে। তিন কোটি হোল্ডিংয়ের মধ্যে প্রায় এক কোটি হোল্ডিংয়ের ডাটা এন্ট্রির কাজ এরই মধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে যেকোনো নাগরিক যেকোনো স্থান থেকে ভূমি উন্নয়ন কর সংক্রান্ত তথ্য জানতে পারবেন।
অনলাইনে পরিশোধ করতে পারবেন, অনলাইনেই দাখিলা পেয়ে যাবেন। এতে সময় বাঁচবে, খরচ বাঁচবে। হয়রানি থেকেই মানুষ রক্ষা পাবে। পাশাপাশি ভূমি উন্নয়ন কর সরাসরি সরকারের কোষাগারে জমা হবে। আগে হয়তো যা পাওয়া যেত কিছু যেত, কিছু যেত না। এখন আর তা হবে না।’
উপজেলা ভূমি অফিস জীর্ণ কেন?
দেশের বিগত কোনো সরকারই উপজেলা ভূমি অফিসগুলো সংস্কারে কোনো উদ্যোগ নেয়নি কেন তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, ‘আমরা ভূমি ব্যবস্থাপনাটা আরও উন্নত করতে চাই। সেই সাথে আমরা জানি, সারা দেশে ঠিকমতো কাজ করা যেত না।
‘কিছুক্ষণ আগে আপনারা যে ভিডিওটা দেখালেন তাতে উপজেলা ভূমি অফিসগুলোর যে জীর্ণদশা, এই জীর্ণ দশা কেন? আমি জানি না। আমাদের আগে তো আরও অনেকেই ক্ষমতায় এসেছেন। কেন এ ব্যাপারে কোনো সংস্কার করা হয়নি, এটাই বড় প্রশ্ন।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘প্রত্যেকটি এলাকায় আমাদের ভূমি অফিসগুলো উন্নত করার যে পদক্ষেপ আমরা নিয়েছি এবং সেখানে যে কর্মকর্তাদের অভাব ছিল, সেটা পূরণেরও ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। বর্তমানে প্রায় সব উপজেলায় সহকারী ভূমি কমিশনার পদায়ন করা হয়েছে।
‘একই সাথে দাপ্তরিক কাজ পরিচালনা, মোবাইল কোর্ট পরিচালনার জন্য যানবাহন প্রদান করা হয়েছে। এতে প্রশাসনের গতিশীলতা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং জনগণকে কাঙ্ক্ষিত সেবাও দিতে পারছে।’
তিনি বলেন, ‘দেশের বেশিরভাগ উপজেলা ভূমি অফিসগুলি জরাজীর্ণ ছিল। এখন সব জায়গায় আমরা নতুন অফিস করে দিচ্ছি। ১৩৯টি উপজেলা ভূমি অফিস নির্মাণের কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়, তার মধ্যে ১২৯টির নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়েছে। প্রত্যেকটি উপজেলার অফিসগুলিকে নতুনভাবে গড়ে তোলা। যেগুলো হয়নি, সেগুলো দ্রুত প্রকল্প নিয়ে কাজ সম্পন্ন করতে হবে। এখান থেকেও মানুষ যথাযথ সেবা পাবে।
‘আমাদের ভূমি অফিসগুলো বিভিন্ন জায়গায় ছড়ানো-ছিটানো ছিল। আমরা আস্তে আস্তে সব অফিসগুলোকে এক ভবনে আনছি। মানুষ যাতে সব সেবা এক জায়গায় পেতে পারে, সে ব্যবস্থাটা আমরা নিয়েছি।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নটা পূরণ করতে হবে। তার জন্য সবচেয়ে বেশি দরকার মানুষের বাসস্থান, মানুষের অধিকার নিশ্চিত করা এবং মানুষের জীবনটাকে সুন্দর করে গড়ে তোলা। সে লক্ষ্য নিয়েই আমরা পদক্ষেপ নিই। তা ছাড়া আমরা দেখেছি শুধু আমাদের দেশই নয়, বিশ্বের সব দেশেই যখন নগরায়ন শুরু হয়, তখন কিন্তু সেটা যদি সুপরিকল্পিতভাবে হয়, তাহলে কোনো অসুবিধা হয় না।
‘কিন্তু যখন এটা শুরু হয় তখন সেটা পরিকল্পনা মাফিক হয় না। কাজেই নগরায়নের চাপে একদিকে আমরা যেমন কৃষিজমি হারাই, অন্যদিকে বনায়ন ধ্বংস হয়, পরিবেশ নষ্ট হয়। এটা খুব একটা স্বাভাবিক নিয়মই ছিল। কিন্তু আমরা সরকারে আসার পর থেকে আমাদের প্রচেষ্টাই ছিল ভূমির ব্যবহার, ভূমি উন্নয়ন এবং ভূমিকে যথাযথভাবে রক্ষা করা। যেমন কৃষি জমি রক্ষা করা, আবার মানুষের বসতিও সুন্দভাবে গড়ে তোলা। প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে মানুষকে রক্ষা করা এসব বিষয় মাথায় রেখেই আমরা বিভিন্ন পদক্ষেপ নিই।’
তিনি বলেন, ‘ভূমি ব্যবহারের জন্য যে একটা নীতিমালা প্রয়োজন, আমাদের নির্বাচনি ইশতেহারেও এটা আমরা যুক্ত করেছিলাম। ২০০১ সালে আমরা সে ধরনের একটি নীতিমালা প্রণয়নও করি। ১৯৯৬ সালে আমরা যখন সরকার গঠন করি তখনই আমরা কিছু পদক্ষেপ নিই।
‘২৮টি মৌলিক বিষয় এতে সংযোজন করি। একটি জাতীয় ভূমি ব্যবহার কমিটিও আমরা সে সময় গঠন করেছিলাম।’
অধিগ্রহণের জমি ব্যবহারে আর সমস্যা হবে না
দেশের সরকারি সব জমির তথ্যভান্ডার তৈরির ফলে এখন থেকে অধিগ্রহণ করা জমিতে প্রকল্প নিতে আর কোনো সমস্যা হবে না বলে আশা প্রকাশ করেছেন সরকারপ্রধান।
তিনি বলেন, ‘দেশের সায়রাত মহাল অর্থাৎ যেখানে জলাভূমি আছে সেগুলোর ডিজিটাল ডেটাবেজ ছিল না। এর জন্য এগুলোর তথ্য পেতে দীর্ঘ সময় লাগে। যেকোনো প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গেলে সবচেয়ে বেশি সমস্যা হয় এই ভূমি নিয়ে।
‘কোথায় ভূমি পাওয়া যাবে, সেগুলোর মালিকানা খোঁজা, তারপর অর্থ পরিশোধ করা…অনেক ঝামেলা। ডিজিটাইজড হলে আর ডাটাবেজ থাকলে কোথায় কোন জমি আছে, কী অবস্থায় আছে, সেটা এই ভূমি তথ্য থেকে সব পাওয়া যাবে। এতে কাজগুলো করতে সুবিধা হবে। ভবিষ্যতে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন আরও সহজতর হবে।’
সরকারপ্রধান বলেন, ‘আরেকটা সমস্যা ছিল, ডাটাবেজ না থাকার কারণে অনেক সময় অনেক দপ্তর বা সংস্থা তাদের কত জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে বা কোথায় আছে, তা জানতে পারত না।
‘ফলে আবার নতুন জমি অধিগ্রহণের জন্য…আর যে কোনো প্রকল্প হলে একটু নতুন জমি অধিগ্রহণের বিষয়ে অনেকের আবার আকাঙ্ক্ষাটাও বেশি থাকে। এ রকম একটি মানসিকতা আমি লক্ষ করি। কিন্তু এখন যেহেতু একটি ভূমি ব্যাংক হয়ে যাচ্ছে, এখন আর অধিগ্রহণকৃত জমি ব্যবহারে কোনো সমস্যা হবে না।’
তিনি বলেন, ‘নতুন পদ্ধতিতে রেকর্ডগুলি সুরক্ষিত থাকবে। হার্ড কপিও যেমন থাকবে, আবার ডিজিটাল পদ্ধতিতেও সফট কপি থাকবে। তথ্য পেতে আর কোনো অসুবিধা হবে না।
‘এই সেবা নিশ্চিত করতে ইউনিয়ন পর্যায়ে ১৪৯৮টি ভূমি অফিস নির্মাণের প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এর মধ্যে ৯৯৫টির নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়েছে। আশা করি বাকিগুলিও খুব দ্রুত শেষ হবে।
Leave a Reply