গুরতর অসুস্থ বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার চিকিৎসা বাংলাদেশে দিনে দিনে কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
শুক্রবার (১২ মার্চ) সকালে জাতীয়তাবাদী কৃষক দলের জাতীয় সম্মেলনে দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা তুলে ধরতে গিয়ে তিনি এ মন্তব্য করেন।
মির্জা ফখরুল বলেন, ‘আমরা একটা কঠিন সময় পার হচ্ছি, একটা সংকট মুহূর্ত পার হচ্ছি। আমাদের দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া আজকে অন্যায় মামলায় সাজা দিয়ে আটক করে রাখা হয়েছে। তিনি অসুস্থ। এই দু-তিনদিন আগে তাঁর সাজা আরও ৬ মাস স্থগিত করছে বলছে। কোথায় সাজা স্থগিত করছে?’
সরকারের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, ‘আপনারা তাঁকে (খালেদা জিয়া) গৃহবন্দি করে রেখেছেন। চিকিৎসার জন্য তিনি বাইরে যেতে চেয়েছেন, সেটাও আপনারা দেন নাই। আপনারা তাকে বাংলাদেশে রেখেই চিকিৎসা করতে বলছেন। যেখানে তাঁর চিকিৎসা অত্যন্ত কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে দিনে দিনে।’
মির্জা ফখরুল বলেন, ‘আমরা অবিলম্বে দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি চাই। আমরা এর নিচে কিছু চাই না। মুক্তি দিতে হবে, নিঃশর্তভাবে মুক্তি দিতে হবে।’
‘আমাদের যেসব সমস্ত নেতাকর্মী বন্দি আছেন তাদের সকলের মুক্তি দিতে হবে। আমাদের নেতা ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সাহেবের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করতে হবে, আমাদের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ৩৫ লক্ষ মামলা আছে সেই প্রত্যাহার করতে হবে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল করতে হবে’- বলেন তিনি।
গুলিস্তানে মহানগর নাট্যমঞ্চে জাতীয়তাবাদী কৃষক দলের চতুর্থ জাতীয় সম্মেলননের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হয়। টানা ২২ বছর পর কৃষক দলের এই জাতীয় সম্মেলন হচ্ছে। সর্বশেষ সম্মেলন হয়েছিলো ১৯৯৮ সালের ১৬ মে।
সকাল ১০টায় মহানগর নাট্যমঞ্চের প্রাঙ্গণে জাতীয় পতাকা ও দলীয় উত্তোলন, রঙিন বেলুন ও সাদা কবুতর উন্মুক্ত করে সম্মেলনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন বিএনপি মহাসচিব ও কৃষক দলের আহবায়ক শামসুজ্জামান দুদু। এসময়ে জাতীয় সঙ্গীত এবং পরে দলীয় সঙ্গীত পরিবেশন করা হয়।
বিকেল ৩টায় গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে হবে সম্মেলনের দ্বিতীয় পর্ব কাউন্সিল অধিবেশন। এই সম্মেলনে সারা দেশ থেকে আসা সংগঠনটির ৫৪৮ জন কাউন্সিলর অর্থাৎ ৭৯টি সাংগঠনিক জেলার ৩৯৫ জন এবং কেন্দ্রীয় আহ্বায়ক কমিটির ১৫৩ জন প্রতিনিধি অংশ নেন।
উদ্বোধনীর অনুষ্ঠানের বক্তব্যের সমাপ্তিতে সংগঠনের বিধান অনুযায়ী নতুন নেতৃত্ব নির্বাচনের পূর্বাহ্নে কৃষক দলের ১৫৩ সদস্যের আহবায়ক কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করেন বিএনপি মহাসচিব। বিকেলে কাউন্সিল অধিবেশনে নতুন নেতৃত্ব নির্বাচন হবে।
গত বছরের ২৭ ফেব্রুয়ারি শামসুজ্জামান দুদুর নেতৃত্বে ১৫৩ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি গঠন করে বিএনপি।
সরকারের উদ্দেশ্যে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘আপনারা অন্যায়ভাবে ক্ষমতায় বসে আছেন, দখল করে বসে আছেন। কী তফাত আপনাদের পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর সঙ্গে, আমাকে বুঝাবেন একটু? আমি পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর সাথে আপনাদের কোনও তফাত দেখি না। তারাও জোর করে বন্দুক দিয়ে মানুষকে মেরে ক্ষমতা দখল করে বসেছিলো। আপনারা আজকে সেই একই কায়দায় মানুষকে হত্যা করে, নির্যাতন করে, জোর করে ক্ষমতায় বসে আছেন।’
তিনি বলেন, ‘দয়া করে আপনাদের একদম অতীতের কথা চিন্তা যখন আপনারা গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করেছিলেন সেই কথা চিন্তা করে আওয়ামী লীগকে যদি বাঁচাতে চান তাহলে অবিলম্বে যা আপনারা করেছেন তার জন্য মাফ চেয়ে দেশের মানুষের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যবস্থা করেন। পদত্যাগ করেন, নির্বাচন দিন, নতুন নির্বাচন কমিশনের পরিচালনায় নির্বাচনে নতুন সরকার আসুক, নতুন পার্লামেন্ট আসুক।’
কৃষকদের দুরাবস্থার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘দেশের কৃষকদের সংগঠিত করতে হবে। তাদের অধিকার আদায় করতে কৃষক দলকে সক্রিয় হতে হবে। দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া তিনি ৫ হাজার টাকার কৃষক ঋণ সুদসহ মওকুফ করে দিয়েছিলেন। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মাফ করে দিয়েছিলেন। বিএনপি যখনই ক্ষমতায় এসেছে তখনই কৃষকদের ঋণ সহজ করে দিয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘এই সরকার এখন পর্যন্ত কৃষকদের জন্য এমন কিছু করেনি যা দিয়ে তারা বলতে পারবে আমরা কৃষকদের জন্য এই এই কাজগুলো করেছি। কোবিড-১৯ এর প্রণোদনা দিয়েছে বিভিন্ন সেক্টারে, কৃষি ক্ষেত্রেও দিয়েছে কিন্তু কৃষি ক্ষেত্রের টাকাগুলো তাদের নেতারা (আওয়ামী লীগ) পকেটে ভরে নিয়েছে। আড়াই হাজার টাকা করে অনুদান দেয়ার কথা ছিলো সেটাও তারা পকেটে ভরে নিয়েছে। এই সরকার লুটেরা সরকারে পরিণত হয়েছে।’
ফখরুল বলেন, ‘আওয়ামী লীগ এই দেশটাকে পৈত্রিক সম্পত্তি করে নিয়েছে। এই যে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের তিনি খুব সুন্দর সুন্দর কথা বলেন। চমৎকার চমৎকার আসনে বসে, ফিরোজা রঙের একটা আসনে বসে তিনি প্রতিদিন বিএনপির বিরুদ্ধে বিষোদগার করতে থাকেন, প্রতিদিন তিনি বিএনপিকে ধমক দেন, শিক্ষা দেন। আরে আপনি আগে নিজের ঘরকে শিক্ষা দেন।’
ওবায়দুল কাদেরের উদ্দেশ্যে ফখরুল আরও বলেন, ‘আপনার ভাই কাদের মির্জা সাহেব যে সমস্ত কথা আপনার সম্পর্কে বলে, আপনাদের নেতাদের সম্পর্কে বলে সেটার পরে তো আপনাদের থাকার কথা না, পদত্যাগ করা উচিত। আপনারা নিজের ঘরে নিজেরা মারামারি করে, দলাদলি করে ইতিমধ্যে দুইজনকে হত্যা করেছেন-একজন সাংবাদিক, একজন রাজনৈতিক কর্মী। কোনো বিচার নাই। এটাই সমগ্র বাংলাদেশের চিত্র। আমরা দেখেছি, কিভাবে আজকে রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে, সমগ্র দেশটাকে তাদের দলীয় সম্পত্তি বানিয়ে ফেলেছে এবং দেশটাকে তারা শোষন করছে। হাজার হাজার কোটি টাকা পাঁচার করছে….। এই দেশটাকে তারা লুটেরা স্বর্গ রাজত্ব তৈরি করেছে।’
উন্নয়নের নামে সরকার মেগা লুট করছে অভিযোগ করে তিনি বলেন, ‘আজকের পত্রিকায় দেখলাম ফাস্টেড ট্রেন, দ্রুতগামী ট্রেন চট্টগ্রাম থেকে ঢাকার জন্য দুটা চীনা কোম্পানি তারা সাপ্লাইয়ার্স ক্রেডিটে এটা করে দিতে চায়। পয়সা দেবে কে? পয়সা ওরা (চীন) এখন দেবে্ এবং সরকার আমাদের পকেট থেকে কেটে নেবে।’
‘আমাদের প্রশ্ন ওই জায়গায় আপনারা যে উন্নয়ন উন্নয়ন বলে চিৎকার করছেন, এই উন্নয়নে লাভবান হচ্ছে কে? লাভবান হচ্ছে আপনাদের কিছু মানুষ যারা কমিশন এজেন্সি করে, যারা দালালি করে, বখরা করে শুধু মাত্র আপনাদের মানুষ উপকৃত হচ্ছে, সাধারণ মানুষ কোনোভাবেই উপকৃত হচ্ছে না’- বলেন ফখরুল।
এ ব্যবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটাতে কৃষক দলকে এলাকায় গিয়ে কৃষকদের সংগঠিত করে একটা গণঅভ্যুত্থানের সূচনা করার আহবানও জানান বিএনপি মহাসচিব।
কৃষক দলের আহবায়ক শামসুজ্জামান দুদুর সভাপতিত্বে ও সদস্য এসকে সাদীর পরিচালনায় উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে কৃষক দলের সৈয়দ মেহেদি আহমেদ রুমি, একেএম মোয়াজ্জেম হোসেন, নাজিমউদ্দিন, আফতাব উদ্দিন আহমেদ মন্ডল, জামালউদ্দিন মিলন, এমএ হালিম, নাসির হায়দার, মাইনুল ইসলাম, জিয়াউল হায়দার পলাশ, লুতফুর রহমান, মাহমুদুল হক সানু, শরীফুল ইসলাম মোল্লা, মহসিন আহমেদ তুষার, আনোয়ারুল হক, এনায়েতুল্লাহ খোকন, রবিউল হাসান পলাশ, সালাহউদ্দিন খান মিলকী, নাসিরউদ্দিন আহমেদ বাচ্চু, রফিকুল আলম রফিক, মাহবুবুর রহমান আউয়াল, আনোয়ারুল ইসলাম বাদশা বক্তব্য রাখেন।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সাংগঠনিক প্রতিবেদন পেশ করেন কৃষক দলের সদস্য সচিব হাসান জাফির তুহিন এবং শোক প্রস্তাব উত্থাপন করেন তকদির হোসেন জসিম।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা হাবিবুর রহমান হাবিব, সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, খায়রুল কবির খোকন, ফজলুল হক মিলন, সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স, শহিদুল ইসলাম বাবুল, অনিন্দ্র্য ইসলাম অমিত, আবদুল খালেক, ছাত্র দলের ইকবাল হোসেন শ্যামল উপস্থিত ছিলেন।
Leave a Reply