দাম নিয়ন্ত্রণে আনতে বেসরকারিভাবে চাল আমদানিতে শুল্ক কমানো হয়। কিন্তু তা কাজে আসছে না। চালের দাম আবারও বাড়তে শুরু করেছে। এ নিয়ে ক্ষুব্ধ ক্রেতারা। কতদিন এ ‘চালবাজি’ চলবে, প্রশ্ন তুলেছেন তারা।
আগে চালের আমদানি শুল্ক ছিল ৬২ দশমিক ৫০ শতাংশ। চালের দাম বাড়তে থাকায় বাজারদর স্থিতিশীল রাখতে গত ২৭ ডিসেম্বর আমদানি শুল্ক কমিয়ে ২৫ শতাংশ নির্ধারণ করে সরকার। কিন্তু তাতেও নিয়ন্ত্রণে নেই চালের দর।
১০ লাখ ১৭ হাজার ৫০০ টন চাল আমদানির অনুমতি
খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বেসরকারিভাবে মোট ১০ লাখ ১৭ হাজার ৫০০ টন চাল আমদানির অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে গত ৩ জানুয়ারি ১০ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে এক লাখ পাঁচ হাজার টন চাল আমদানির অনুমতি দেয় সরকার। পরের দিন ৪ জানুয়ারি আরও ১৯ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে দুই লাখ ২৫ হাজার টন চাল আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়।
তিন শতাধিক প্রতিষ্ঠানকে মোট ১০ লাখ ১৭ হাজার ৫০০ টন চাল আমদানির অনুমতি দেওয়া হলেও এলসি খোলা হয়েছে ছয় লাখ ৮৫ হাজার ৬৬৯ টনের। এখন পর্যন্ত বেসরকারিভাবে দেশে এসেছে তিন লাখ ১২ হাজার টন চাল। সরকারি পর্যায়ে এসেছে আরও এক লাখ ২১ হাজার টন চাল
গত ৬ জানুয়ারি ৪৯ প্রতিষ্ঠানকে এক লাখ ৭৪ হাজার ৫০০ টন এবং ১০ জানুয়ারি ৬৪ প্রতিষ্ঠানকে এক লাখ ৭১ হাজার ৫০০ টন চাল আমদানির অনুমতি দেয় সরকার। গত ১৩ জানুয়ারি ৪৩ প্রতিষ্ঠানকে এক লাখ ছয় হাজার ৫০০ টন চাল আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়। সর্বশেষ গত ১ মার্চ ৫৭ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে এক লাখ ৮০ হাজার টন চাল আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়।
৬ লাখ ৮৫ হাজার ৬৬৯ টন চালের জন্য খোলা হয়েছে এলসি
তিন শতাধিক প্রতিষ্ঠানকে মোট ১০ লাখ ১৭ হাজার ৫০০ টন চাল আনতে অনুমতি দেওয়া হলেও এলসি খোলা হয়েছে ছয় লাখ ৮৫ হাজার ৬৬৯ টনের। এখন পর্যন্ত বেসরকারিভাবে দেশে এসেছে তিন লাখ ১২ হাজার টন চাল। সরকারি পর্যায়ে এসেছে আরও এক লাখ ২১ হাজার টন চাল।
“যেভাবে চালের দাম আবারও বাড়ছে, গরিব মানুষ খাবে কী? সামনে রমজান। সরকারের উচিত দ্রুত চালের দাম কমাতে ব্যবস্থা নেওয়া”
মাহবুব হোসেন, ক্রেতা
কেজিতে দাম বেড়েছে ২ থেকে ৩ টাকা
আমদানি শুল্ক কমানোর ঘোষণার পর চালের দাম কিছুটা কমে। পরবর্তী সময়ে তা আবারও বাড়তির দিকে। নতুন করে কেজিতে চালের দাম বেড়েছে ২ থেকে ৩ টাকা। বাজার ঘুরে দেখা গেছে, চিকন চাল কেজিপ্রতি ৬৫-৬৭ টাকা এবং মোটা চাল ৪৮-৫৬ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
ক্ষুব্ধ ক্রেতারা
আহমেদ মোরশেদ নামের এক ক্রেতা ঢাকা পোস্টকে বলেন, শুনলাম চালের দাম কমে যাবে। কিন্তু এখন দেখছি উল্টো আরও বেড়েছে। চাল নিয়ে এত চালবাজি হচ্ছে কেন? আর কতদিন দেখতে হবে এ দৃশ্য?
“পাইকারি বাজারে দাম বেশি, তাই আমাদেরও বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে। পাইকারি বাজারে কমলে আমরাও কম দামে বিক্রি করব”
আবুল কাশেম, খুচরা চাল ব্যবসায়ী, মোহাম্মদপুর
মাহবুব হোসেন নামের আরেক ক্রেতা ঢাকা পোস্টকে বলেন, যেভাবে চালের দাম আবারও বাড়ছে, গরিব মানুষ খাবে কী? সামনে রমজান। সরকারের উচিত দ্রুত চালের দাম কমাতে ব্যবস্থা নেওয়া।
কী বলছেন ব্যবসায়ীরা
মোহাম্মদপুরের খুচরা ব্যবসায়ী আবুল কাশেম বলেন, পাইকারি বাজারে দাম বেশি, তাই আমাদেরও বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে। পাইকারি বাজারে কমলে আমরাও কম দামে বিক্রি করব।
গত বছরের এ সময়ে যে চাল ৫০ টাকা কেজিতে পাওয়া যেত, সে চালের দাম এখন ৬০ টাকা। অর্থাৎ বছর ব্যবধানে ১০ টাকা বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে চাল। টিসিবির তথ্যানুযায়ী, গত এক বছরে চিকন চালের দাম ১৩ শতাংশ এবং মোটা চালের দাম বেড়েছে ৩৭ শতাংশ। মাঝারি চালের দাম বেড়েছে ১৭ শতাংশ
কারওয়ান বাজারের পাইকারি ব্যবসায়ী আমির হোসেন। তিনি বলেন, আমরা মিল মালিকদের কাছ থেকে চাল এনে বিক্রি করি। দাম বাড়ানোয় আমাদের কোনো হাত নেই।
অস্থির চালের বাজার, ভুক্তভোগী ক্রেতারা
এক বছরের ব্যবধানে দাম ১০ টাকা বেশি
সরকারি বিপণন সংস্থা টিসিবির হিসাবে, গত বছরের এ সময়ে যে চাল ৫০ টাকা কেজিতে পাওয়া যেত, সে চালের দাম এখন ৬০ টাকা। অর্থাৎ বছর ব্যবধানে ১০ টাকা বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে চাল। সংস্থাটির তথ্যানুযায়ী, গত এক বছরে চিকন চালের দাম ১৩ শতাংশ এবং মোটা চালের দাম বেড়েছে ৩৭ শতাংশ। মাঝারি চালের দাম বেড়েছে ১৭ শতাংশ।
আমদানির গতি মন্থর
জানতে চাইলে খাদ্য সচিব ড. মোছাম্মৎ নাজমানারা খানুম বলেন, বেসরকারিভাবে চাল আমদানির জন্য শুল্ক কমিয়েছে সরকার। কিন্তু যে গতিতে দেশে চাল আসার কথা, সে গতিতে আসেনি। কাঙ্ক্ষিত গতিতে চাল আসলে দাম কমে যেত।
“বেসরকারিভাবে চাল আমদানির জন্য শুল্ক কমিয়েছে সরকার। কিন্তু যে গতিতে দেশে চাল আসার কথা, সে গতিতে আসেনি। কাঙ্ক্ষিত গতিতে চাল আসলে দাম কমে যেত”
ড. মোছাম্মৎ নাজমানারা খানুম, খাদ্য সচিব
তিনি বলেন, ‘সীমান্ত এখন কিন্তু আগের অবস্থায় নেই। আগে আমদানির অনুমতি দিলেই পরের দিন চাল চলে আসত। কিন্তু এখন বন্দর দিয়ে অনেক পণ্য আসে, ব্যস্ত বন্দর। তাই সময়ও একটু বেশি লাগছে।’
খাদ্য সচিব আরও বলেন, আমদানির চাল যাতে দ্রুত দেশে আসতে পারে সেজন্য স্বরাষ্ট্র, পররাষ্ট্র ও রেল মন্ত্রণালয়কে আমরা অনুরোধ করেছি। ফলে আমদানির গতি কিছুটা বেড়েছে। এ গতি অব্যাহত থাকলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসবে বলে আশা করছি।
আসছে রমজান, চালের দাম আরও বাড়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা
আমদানি ইস্যুতে কন্ট্রোল রুম গঠন
বেসরকারি পর্যায়ে চাল আমদানি ইস্যুতে কন্ট্রোল রুম গঠন করেছে খাদ্য মন্ত্রণালয়। ছয় সদস্যের এ কন্ট্রোল রুমের দায়িত্বে আছেন খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব মুহাম্মদ মাহবুবুর রহমান, হুরে জান্নাত, শারমিন ইয়াসমিন, প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. আমিনুল ইসলাম হাজারী, মো. মতিউর রহমান ও মো. মুরাদুজ্জামান।
বেসরকারি পর্যায়ে বিদেশ থেকে চাল আমদানির ক্ষেত্রে কী পরিমাণ এলসি খোলা হচ্ছে, এলসি মোতাবেক চাল আমদানি করা হয়েছে কি না—বিষয়গুলো তদারকি করবে এ কন্ট্রোল রুম। এছাড়া আমদানি করা চাল কোথায় বিক্রি হচ্ছে এবং মাঠ পর্যায়ে খাদ্য অধিদফতরের কর্মকর্তারা বিষয়টি যথাযথভাবে মনিটরিং করছেন কি না—সে বিষয়ও তদারকি করবে এ কন্ট্রোল রুম।
সরকারিভাবে চাল আমদানি তদারকিতে মনিটরিং সেল
সরকারিভাবে চাল আমদানি কার্যক্রম তদারকিতে অস্থায়ীভাবে তিন সদস্যের একটি মনিটরিং সেল গঠন করেছে সরকার। গত ১ মার্চ এ সেল গঠন করে খাদ্য অধিদফতর থেকে অফিস আদেশ জারি করা হয়।
মন্থর আমদানির গতি, এ কারণে দাম নিয়ন্ত্রণে সময় লাগছে- বলছে মন্ত্রণালয়
সেলের প্রধান করা হয়েছে খাদ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত পরিচালক মো. মনিরুজ্জামানকে। এছাড়া সহযোগী প্রধান হিসেবে আছেন সহকারী উপপরিচালক মুহাম্মদ আবদুল মালেক খন্দকার এবং সহযোগী হিসেবে আছেন উচ্চমান সহকারী মো. বায়জিদ খান।
অফিস আদেশে বলা হয়, চাল আমদানির জন্য চুক্তিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করে চুক্তির আওতায় জাহাজ/বার্জের নামসহ, জাহাজিকরণ করা এবং জাহাজিকরণ চালের পরিমাণ সংগ্রহ করবে। চট্টগ্রাম ও মোংলার চলাচল ও সংরক্ষণ নিয়ন্ত্রকের সঙ্গে যোগাযোগ করে সরবরাহকারী ভিত্তিক চালের আগমন, খালাস ও ভাসমান পরিমাণের তথ্য সংগ্রহ করবে। এসব বিষয়ে ছক অনুযায়ী খাদ্য অধিদফতরের মহাপরিচালকের কাছে প্রতিদিন প্রতিবেদন দেবে।
Leave a Reply