জিয়াউর রহমান পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে কখনো গুলি চালিয়েছে এ রকম নজির নেই বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
মঙ্গলবার (৩১ আগস্ট) রাজধানীর কৃষিবিদ ইন্সটিটিউশন মিলনায়তনে ছাত্রলীগ আয়োজিত জাতীয় শোক দিবসের আলোচনা সভায় গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে যুক্ত হয়ে তিনি এ কথা বলেন।
শেখ হাসিনা বলেন, এখনও যুদ্ধাপরাধী, পরাজিত শক্তি এবং পনেরই আগস্টের খুনি, ফাঁসি যাদের হয়েছে তারা তো বটেই, তাদের ছেলেপেলে যারা এবং যুদ্ধাপরাধী ‑ যাদের ফাঁসি হয়েছে তাদেরও ছেলেপেলে, দোসর বা বংশধর তারা এখনও বাংলাদেশের বিরুদ্ধে চক্রান্ত চালিয়ে যাচ্ছে, ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে। যে সকল আন্তর্জাতিক শক্তি আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় বিরোধিতা করেছিল তাদের কিছু কিছু এদেরকে মদত দিয়ে থাকে। কাজেই এই ব্যাপারে জাতিকে সতর্ক থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে‑ পদে পদে সতর্ক থাকতে হবে।
পঁচাত্তর পরবর্তী সময়ের পরিস্থিতি তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সেই সময় যারা স্থানীয় দালালচক্র, যারা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দোসর‑ তারা কোনও দিন চায়নি বাংলাদেশ স্বাধীন হোক। তারপরও যখন বাংলাদেশ স্বাধীন হলো, বিজয় অর্জন করলো, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী পরাজিত হলো- তখন সেই পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতেই পনেরই আগস্ট এই হত্যাকাণ্ড তারা চালিয়েছিল। এর পরে বাংলাদেশের ইতিহাস থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নামটা সম্পূর্ণ মুছে ফেলা হয়েছিল।
তিনি বলেন, জয় বাংলা স্লোগান‑ যে স্লোগান দিয়ে লাখো শহীদ রক্ত দিয়েছে, সেই স্লোগান নিষিদ্ধ করলো। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ, মুক্তিযুদ্ধের সব কিছু ধ্বংস করা হয়েছিল। ভাবখানা এমন হয়েছিল যে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়নি। আবার সেই পাকিস্তানের একটা প্রদেশ হিসেবে বাংলাদেশ যেন সৃষ্ট এবং সেই পাকিস্তান এসে আবার আমাদের ওপর খবরদারি করবে‑ অনেকের এমন আকাঙ্ক্ষা ছিল।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, পঁচাত্তরের পরে যারা সংবিধান লঙ্ঘন করে অবৈধভাবে হত্যা, ক্যু, ষড়যন্ত্রের মধ্য দিয়ে ক্ষমতা দখল করে সেখানে যেমন আমাদের দলেরও কিছু বেঈমান-মোনাফেক-মীরজাফর ছিল। যেমন খন্দকার মোশতাক গং। আর তার শক্তিটা ছিল জিয়াউর রহমান। জিয়াউর রহমান মুক্তিযুদ্ধে একটা সেক্টর কমান্ডার অর্থাৎ সেখানে খালেদ মোশাররফ আহত হলে জিয়াকে সেক্টর কমান্ডার করা হয়েছিল। কিন্তু পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে জিয়াউর রহমান কখনও গুলি চালিয়েছে ‑ এ রকম নজির নাই। এ রকম কোনও নজির কেউ দেখাতে পারবে না।
তিনি বলেন, যখন মোশতাক বা রশীদ-ফারুক বিবিসিতে যে ইন্টারভিউ দিয়েছে পনেরই আগস্টের পর, সেই ইন্টারভিউতে তারা স্বীকার করেছে। শুধু তাই না অনেক পত্রিকায়ও তাদের বক্তব্য এসেছে। যে জিয়াউর রহমান এই খুনিদের সাথে সব সময় ছিল এবং জিয়াউর রহমানই ছিল মূল শক্তির উৎস। সে-ই বেঈমানিটা করেছিল। অথচ জিয়াউর রহমান ছিল একটা মেজর। স্বাধীনতার পর মাত্র তিন বছরের মধ্যে মেজর থেকে একটা প্রমোশন দিয়ে মেজর জেনারেল করা হয়েছিল। সেটা করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব‑ সমস্ত সেনাবাহিনী যখন তিনি পুর্নগঠন করেন।
সরকার প্রধান বলেন, কাজেই সেটাও তাদের ভোলা উচিত না ‑ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের বদৌলতেই যে জিয়াউর রহমান মেজর থেকে মেজর জেনারেল হয়েছিল। পাকিস্তান দেশটা থাকলে ওই মেজর হিসেবেই তার রিটায়ার্ড করতে হতো। তার ওপরে আর উঠতে পারতো কী না সন্দেহ। কিন্তু সেই বেঈমানি-মোনাফেকি তারা করেছিল। তখন যে ভূমিকা নেওয়ার কথা ছিল‑ কেউ নেয়নি। জাতির পিতার লাশ, সকলের লাশ ১৬ তারিখ পর্যন্ত ওই বত্রিশ নাম্বারের বাড়িতেই ছিল। কাফন-দাফনের ব্যবস্থাটুকু পর্যন্ত করা হয়নি।
তিনি বলেন, যারা বেঈমানি করে এবং এই বেঈমানির ইতিহাস যদি দেখা যায়‑ সেনাবাহিনীতে মুক্তিযুদ্ধ যারা করেছে‑ সেই মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের হত্যা করা, হাজার হাজার সেনাবাহিনীর সদস্যকে নির্বিচারে হত্যা করা হয়েছে। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে এমন এমন রাত গেছে যে জোড়ায় জোড়ায় ফাঁসি হয়েছে। ১০ জন, ২০ জন ‑ এ রকম করে একেক রাতে ফাঁসি, শত শত লোককে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে। কে দিয়েছে? জিয়াউর রহমান দিয়েছে। শুধু ঢাকা জেলে না, খুলনা, রাজশাহী বিভিন্ন জায়গায় এই হত্যাকাণ্ড সে চালিয়েছে।
শেখ হাসিনা বলেন, মেধাবী ছাত্র, তাদের হাতে একদিকে যেমন মেধার জন্য পুরস্কার তুলে দিয়েছে অপর দিকে অস্ত্র তুলে দিয়েছে, অর্থ তুলে দিয়েছে, মাদক তুলে দিয়েছে এবং তাদেরকে ব্যবহার করেছে। তাদেরকে বিপথে নিয়ে গেছে। এ রকম বহু মেধাবী ছাত্রকে জিয়াউর রহমান বিপথে ঠেলে দিয়েছে। প্রত্যেকটা বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্ত্রের ঝনঝনানি। শিক্ষার কোনও পরিবেশ ছিল না। তার স্ত্রী খালেদা জিয়া যখন ক্ষমতায় আসে তখনও সে হুমকি দিয়েছিল যে আওয়ামী লীগকে মোকাবিলা করতে তার ছাত্রদলই নাকি যথেষ্ট। তার কারণ ছাত্রদলের হাতে তারা অস্ত্র তুলে দিয়েছে। তাদের লেখাপড়া করতে উৎসাহিত করে নাই।
তিনি বলেন, আমি ছাত্রলীগের হাতে খাতা-কলম তুলে দিয়েছিলাম‑ লেখাপড়া শিখতে হবে। ছাত্রলীগের মূলমন্ত্র শিক্ষা, শান্তি, প্রগতি‑ এই আদর্শ নিয়ে ছাত্রলীগকে তৈরি হতে হবে। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হতে হবে। মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে। কিন্তু ক্ষমতায় এসে জিয়াউর রহমান, এরপরে এরশাদ, তারপরে খালেদা জিয়া ‑ তারা কি করেছে? তারা ছাত্র সমাজকে ধ্বংস করতে চেয়েছে। সুশিক্ষায় শিক্ষিত হোক এই জাতি এটা তারা কখনও চায়নি। অবশ্য চাইবেই বা কী করে, নিজেদের কী অবস্থা সেটাও তো দেখতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই বাংলাদেশে পনেরই আগস্টের যে হত্যাকাণ্ড ঘটে গেছে। এরপরে একুশে আগস্টের গ্রেনেড হামলা। এছাড়াও বহুবার আমার ওপরে হামলা। এমন কী চুয়াত্তর সালে কামালের ওপর হামলা হলো। তাকেও গুলি করে হত্যার চেষ্টা করা হলো। যখন দেখলো সে বেঁচে গেছে তখন তার বিরুদ্ধে অপবাদ দেওয়া হলো। মিথ্যা অপবাদ ছড়ানো হলো। অর্থাৎ যারা পরাজিত শক্তি তারা সব সময় সক্রিয় ছিল।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের ইতিহাসে ছাত্রদের ভূমিকা রয়েছে। আজকে বাংলাদেশের প্রতিটি অর্জন ‑ সেই মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠা থেকে শুরু করে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন বা মিলিটারি ডিক্টেটরশিপের বিরুদ্ধে আন্দোলন বা যে কোনও অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সব সময় ছাত্ররাই করেছে। ছাত্ররাই সংগ্রামে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছে। এ ধরণের বাধা-বিঘ্ন আসতে থাকবে। সৎ পথে থাকলে, সত্যের পথ সব সময় কঠিন হয়, সে কঠিন পথকে যারা ভালোবেসে এগিয়ে যেতে পারে ‑ তারাই সাফল্য আনতে পারে।
Leave a Reply