জোর করে স্বীকারোক্তি আদায়ের ঘটনা তদন্ত কর্মকর্তার ভুল নয়, এটি মারাত্মক অপরাধ বলে মন্তব্য করেছেন হাইকোর্ট।
আজ রোববার (২২ আগস্ট) বগুড়ায় এক শিশুর কাছ থেকে জোর করে ছোট ভাই হত্যার স্বীকারোক্তি আদায় করার ঘটনা পর্যালোচনায় বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন ও বিচারপতি মো. আতাউর রহমানের ভার্চুয়াল হাইকোর্ট বেঞ্চ এ মন্তব্য করেন।
জোর করে স্বীকারোক্তি আদায়ের ওই ঘটনা তদন্ত কর্মকর্তার ভুল নয় ‘মারাত্মক অপরাধ’ হিসেবে দেখছে হাইকোর্ট। রোববার নিঃশর্ত ক্ষমা চাইলেও তদন্ত কর্মকর্তার এমন কাণ্ডে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন আদালত।
জোর করে ১২ বছর বয়সী শিশুর স্বীকারোক্তি নেওয়ার বিষয়ে গত ১১ জুন ‘বিয়ারিং দ্য আনবিয়ারেবল’ শিরোনামে ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টারে একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়।
এটি যুক্ত করে বগুড়ার আদালতে থাকা ওই হত্যা মামলার যথার্থতা ও আইনি পর্যালোচনায় প্রয়োজনীয় নির্দেশনা চেয়ে সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ আইনজীবী গত ২০ জুন আবেদন করেন।
২৯ জুন আবেদনটির ওপর শুনানির পর হাইকোর্ট ‘জোর করে’ স্বীকারোক্তি আদায়ের বিষয়ে ব্যাখ্যা জানতে পুলিশের অপরাধ তদন্ত (সিআইডি) বিভাগের পরিদর্শক (নাটোর) নয়ন কুমারকে তলব করেন।
নয়ন সারিয়াকান্দি থানায় সাবেক উপ-পরিদর্শক (এসআই) হিসেবে মামলাটির প্রথম তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন।
সেই সঙ্গে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনে (পিবিআই) তদন্তাধীন মামলাটির কেস ডকেট (সিডি) নিয়ে বর্তমান তদন্ত কর্মকর্তা মো. মনসুর আলীকেও (উপপরিদর্শক, পিবিআই, বগুড়া) আদালতে হাজির থাকতে বলা হয়।
আদালতের নির্দেশে রোববার সকালে মনসুর আলী ও নয়ন কুমার আদালতে হাজির হন এবং ১২ বছর বয়সী শিশুর কাছ থেকে জোর করে স্বীকারোক্তি নেওয়ার অভিযোগ বিষয়ে লিখিত ব্যাখ্যা দাখিল করেন।
ক্রম অনুসারে বিষয়টি শুনানির জন্য উঠলে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. সারওয়ার হোসেন বাপ্পী আদালতে বলেন, সাবেক ও বর্তমান তদন্ত কর্মকর্তা হাজির হয়েছেন। সাবেক তদন্ত কর্মকর্তা নয়ন কুমার লিখিত জবাব দিয়েছেন।
তখন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেলের উদ্দেশে বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, উনি (নয়ন কুমার) সরাসরি বিচারপতিদের অ্যাড্রেস করেছেন। উনি কি এটি পারেন, জিজ্ঞেস করেন। উনি কীভাবে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তি নিয়েছেন জিজ্ঞেস করেন। উনি ১২ বছর বয়সী শিশুর ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি কীভাবে নিয়েছেন, বলতে বলেন।
মামলার বৃত্তান্ত তুলে ধরে আইন কর্মকর্তা মো. সারওয়ার হোসেন বাপ্পী তখন বলেন, রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনে নারী ও শিশু আদালত পিবিআইকে মামলাটি অধিকতর তদন্ত করতে নির্দেশ দেন। পিবিআই তদন্ত করার সময় দুজনকে গ্রেফতার করেছে। তারা নিজেদের জড়িয়ে স্বীকারোক্তি দিয়েছে।
ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এ পর্যায়ে বলেন, আদালত উনাকে (নয়ন কুমার) আসতে বলেছেন, উনি এসেছেন। নিঃশর্ত ক্ষমা চেয়ে আবেদন দিয়েছেন। আর পিবিআইয়ের যিনি এখন মামলাটি তদন্ত করছেন, তিনি মামলাটির চতুর্থ তদন্ত কর্মকর্তা। উনি ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন, আদালত সন্তুষ্ট হলে ক্ষমা করে দিতে পারেন। কেননা, উনি (নয়ন কুমার) প্রসিকিউসনের অংশ।
তখন বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, উনি ভুল করলে আমরা কি ছেড়ে দেব?
ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, সেটা আপনাদের বিবেচনার ওপর ছেড়ে দিচ্ছি। আমি বলতে চাচ্ছি হি (নয়ন কুমার) অলসো পার্ট অব দ্য প্রসিকিউশন। তিনি যে ভুল করেছেন সে ভুলের জন্য তিনি নিঃশর্ত ক্ষমা চেয়েছেন।
বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারক জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, এটা ভুল নয়, এটা মারাত্মক অপরাধ, যেটা তিনি করেছেন।
ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, অপরাধ বলবেন, নাকি অবহেলা।
বিচারক বলেন, না, তিনি এটা উদ্দেশ্যমূলকভাবে করেছেন। ১২ বছরের একটি শিশুর স্বীকারোক্তি দিয়ে বলেছে ‘আমি আমার ভাইকে মেরে ফেলেছি।’ এটা কি সম্ভব! ১২ বছরের একটি ছেলে ৮ বছরের একটি ছেলেকে মেরে ফেলবে?
‘তাহলে আপনি কীভাবে ১৬৪ ধারা আবেদন দিলেন ও নিলেন? রাষ্ট্রপক্ষ ইতিমধ্যে অধিকতর তদন্ত চেয়েছে, পিবিআই তদন্ত করছে। এতে দুজন স্বীকার করেছে, তারা আট বছর বয়সী শিশুটিকে মেরেছে। তাহলে ১২ বছর বয়সীর শিশুটির জবানবন্দি কীভাবে নিলেন এই তদন্ত কর্মকর্তা (নয়ন)! এটি তো মারাত্মক ধরনের অভিযোগ। অবহেলা মনের অজান্তে হয়। এটি অবহেলা নয়।’
এ পর্যায়ে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ওই কর্মকর্তার (নয়ন) বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা সম্পর্কিত কার্যক্রম শুরু হয়েছে।
এরপর আবেদনকারীদের পক্ষে আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির শুনানি করেন। এর মধ্যে মামলার বর্তমান ও সাবেক তদন্ত কর্মকর্তা আদালতের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন।
তবে নয়ন কুমারের লিখিত ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট হননি আদালত। যে কারণে আগামী ৬ সেপ্টেম্বর পরবর্তী শুনানির তারিখ রাখা হয়েছে। সেদিনও নয়ন কুমারকে আদালতে উপস্থিত থাকতে বলা হয়েছে।
আর ব্যক্তিগত হাজিরা থেকে আপাতত অব্যাহতি দিলেও বর্তমান তদন্ত কর্মকর্তা মো. মনসুর আলীকে সেদিন ভার্চুয়ালি আদালতে যুক্ত থাকতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
Leave a Reply