মজিদ পুত্র বলছি (ছোট গল্প)
লেখকঃ মিজান বিন মজিদ
আমার স্মৃতিশক্তি ভয়ানক নিম্ন মানের। সংখ্যা পরিসংখ্যান মনে থাকে না। কিন্তু আব্বা আব্দুল মজিদের হাত ধরে প্রথম দিন যে স্কুলে গিয়েছি,সেটা আমার স্মৃতিতে অক্ষয় হয়ে আছে। অবশ্য স্কুলে যাবার আগেই নামধাম নামতা ইত্যাদি আব্বা শিখিয়েছিলেন। আমি আমরা গ্রামের জাতক যারা পিতাকে ‘আব্বা’ ডাকি। এই ডাকের চেয়ে হৃদয়গ্রাহী কোন ডাক বাঙালির হতে পারে না। আজকাল বাবা,বাপি,ড্যাড,পাপা পাপ্পি এইসব এসে একটা কৃত্রিম ‘আদুরে’ ভাব এনেছে সত্য,আব্বার অবস্থানে পৌঁছাতে পারে নি।
আমার দুয়েক পোস্টের আগের পোস্টে ট্রেন্ড ফলো না করার অনুরোধ করেছি। আজকের বাবা দিবসে বাবাস্মরণও ট্রেন্ডই। তবে পিছু নিলাম কেন? আমার এই ক্ষুদ্র মানবজীবনে আব্বা আব্দুল মজিদের প্রভাব, প্রভাবের সংক্রামক শক্তি কী বিপুল হয়ে সঞ্চারিত তার কিছুটা আধুনিক পাঠকের সামনে তুলে ধরা কর্তব্য মনে করেছি। কোন ভালো কিছুর অন্তর্নিহিত শক্তি যদি অনতিক্রম্য হয়,তবে তার পেছনে ছোটাই ভালো!
আব্বা ছিলেন নমাজী। দশবছর খুব ভালো করে মনে আছে তাঁর জীবনের। মনে হয় না কোন নমাজ কাযা করেছেন স্বেচ্ছায়। দীর্ঘ সময় নিয়ে, বিভিন্ন দোয়া দরুদপাঠ করে জায়নামাযে বসে থাকতেন। অতিরিক্ত নমাজে সময় ব্যয় করতেন। উবু হয়ে পবিত্র কালামুল্লাহ তিলাওয়াতরত তাঁর ছবি আমার হৃদয় কোণে সঞ্চিত আছে অক্ষর হয়ে।মৃদুভাষী ছিলেন। চিন্তার স্বাতন্ত্র্য ছিলো বিষ্ময়কর। বুদ্ধি দিয়ে পরোপকারে তিনি তাঁর কালে অতুলনীয় কিংবদন্তি।
আমাকে নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকতেন। কী করতে পারবো,এই চিন্তায় বিচলিত হতেন। কায়মনোবাক্যে আমার সর্বাঙ্গীণ মঙ্গল চাইতেন। প্রতি নমাজান্তে গুনগুনিয়ে আমার ভবিষ্যৎ মাঙতেন তাঁর প্রভুর দরবারে। আত্মীয়তাকে খুব বড় করে দেখতেন। আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে নিয়ে যেতেন বগলদাবা করে। একবার মরহুম ফুফাতো ভাই ফয়েজ আহমেদ (পরিচালক ট্রাফিক,চট্টগ্রাম বন্দর) বাবাকে অজু করিয়ে কোলে করে ঘরে তুললেন। আমার কিশোর মুখে হাসি আসলো। তিনি ধমক দিয়ে বলেছিলেন, ” তুই বুঝবি কিরে অভিভাবকদের কী মর্যাদা? ”
আমার পুরো জীবন দুই পয়সা মূল্যের হলে সেই দুই পয়সার দেড়পয়সা তাঁর প্রাপ্য…বাকিটা মায়ের। আবার মা যদি পুরোটা দাবি করেন,সেটা তাঁরা মিটিয়ে নিন! আমার কেন জানি মনে হয়, পাপভারে আমি যদি ন্যুব্জ হয়ে পড়ি বাবা তাতে মনক্ষুন্ন হবেন না! তাঁর জান্নাত অভিযাত্রা আমাকে ছেড়ে পূর্ণ হবে না। তিনি পরিণত বয়সেই পৃথ্বী ছেড়েছিলেন। আমি এই অপরিণত বুদ্ধিতেও বুঝি তিনি একজন স্বশিক্ষিত ‘দার্শনিক’ ছিলেন।
তাঁর দর্শন ছিলো বিদ্যায় মুক্তি,ইলমের মাধ্যমে পরিত্রাণ। শিক্ষার গুরুত্ব আব্বা যেমন বুঝেছিলেন তেমন বুঝ আমারও নাই। তিনি অশিক্ষা নিয়ে বলতেন,” টর্চলাইটের ডোমটাই আসল। ব্যাটারি দিয়ে কী হবে?” বলতেন, বড়’র বড় গুণ শুয়ে ঘাস খায়, ছাগল মগডালে লটকায়! তাঁর ভুমি মাপার জ্ঞান ছিলো অবিশ্বাস্য। লোকের মুখে শুনেছি পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলির অগ্রভাগে যে পরিমাণ ভূমি তার মাপও তিনি করে দিতে পারতেন।
সেই মাটিকে আপন করে ১৯৯৫ সালে তিনি আমার সমস্ত জগতকে চিররিক্ত করে গেলেন৷ আব্বা নাই ছাব্বিশ বছর! তাঁর কবরের সামনে দাঁড়িয়ে নিজের অস্তিত্বকে অপরাধী মনে হয়। প্রশ্ন জাগে তাঁর প্রত্যাশিত পথে কী আছি? ধারণা করি,বেশি এদিকওদিক করে ফেলি নি। ইলহাম বাবার নামের অন্তে মজিদ প্রযুক্ত করেছি যদিচ সে দাদার কিছু পায়টায়…। আমার আব্বাকে ক্ষমা করিও দয়াময়।
লেখা মিজান বিন মজিদ – অধ্যাপক ফেনী গার্লস ক্যাডেট কলেজ।
Leave a Reply