নিত্য পণ্যের বাজার কার নিয়ন্ত্রণে? এমন প্রশ্ন প্রায় সব ক্রেতার। কারণ, পণ্যেও বাজার সকালে এক রকম- বিকেলে আরেক রকম। যেসব পণ্যেও দাম বাড়ার কথা নয় সেইসব পণ্যেরও দাম বাড়ছে। যুক্তিসঙ্গত কোনো কারণ ছাড়াই বাড়ছে দাম। ক্রেতাসাধারণের নাভিশ্বাস উঠেছে। বাজারে গিয়ে পছন্দের পণ্যই চাহিদামতো কিনতে পারছেন না অনেকেই। আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের সঙ্গতি রাখতে গিয়ে জরুরি প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র না কিনেই ঘরে ফিরছেন। কিন্তু সরকারের যেন কিছুই করার নেই। সরকার যেন একেবারেই অসহায়। সবকিছুর চাবিকাঠি যেন বাজার সিন্ডিকেটের হাতেই। সরকারকেও যেন তারা নিয়ন্ত্রণ করছে, এমন অভিযোগ উঠেছে। বাণিজ্যমন্ত্রী গত ফেব্রুয়ারি এক বক্তৃতায় বলেছেন, এক মাসের মধ্যে চালের বাজার স্বাভাবিক হয়ে যাবে। কিন্তু তার সেই বক্তব্যেও মাস অতিক্রম করতে চললো; চালের দাম স্বাভাবিক তো দূরের কথা, আগের চেয়ে আরো বেড়েছে। যদিও খাদ্যমন্ত্রী-সচিব এ বিষয়ে একেবারেই চুপ রয়েছেন এখন। অভিযোগ রয়েছে, চালের এই কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি খাদ্যমন্ত্রী-সচিব দু’জনেরই হাত রয়েছে। এরাই সরকারকে বেকায়দায় ফেলে নিজেদের আখের গুছিয়ে নেয়ার জন্য পরিকল্পিতভাবে দেশে চালের এ সংকট সৃষ্টি করেছেন। সময়মতো প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেননি।
বাণিজ্যমন্ত্রী তার ওই বক্তৃতায় অবশ্য বলেছিলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিন তেলের মূল্য না কমলে তার কিছুই করার নেই। অর্থাৎ দাম বাড়তেই থাকবে। তিনি অসহায়! কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ার আগেই যে অভ্যন্তরীন বাজারে অস্বাভাবিকহারে সয়াবিন তেলের দাম বেড়ে গেছে, অভ্যন্তরীণ বাজারের দাম বৃদ্ধি কি আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ আছেÑ এসব প্রশ্নের কোনো জবাব বাণিজ্যমন্ত্রী দেননি। অবশ্য তিনি নিজেও একজন ব্যবসায়ী। ব্যবসা-বাণিজ্যে লাভ বেশি হওয়া মানে তো তারই লাভ!
বাণিজ্যমন্ত্রী পেঁয়াজের বিষয়ে কিছু বলেননি। কারণ, এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক বাজারের কথা বলা যাচ্ছে না। এখন পেঁয়াজের দাম কেন গত এক সপ্তায় বেড়ে প্রায় দুই গুণের কাছাকাছি চলে গেছে? এর কোনো উত্তর নেই কারো কাছেই। ব্যবসায়ীরাও এর কোনো জবাব দিতে পারছেন না! শুধু চাল বা তেল বা পেঁয়াজই নয়, ডাল, মাছ-গোশত, শাক-সবজি থেকে শুরু করে সব পণ্যের দামই বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। শিশু খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত এ্যাংকর, ডিপ্লোমা, নিডো, মিল্কভিটা, গুড়োদুধ খোলা, গরুর দুধ তরল ও সব প্রকার কনডেন্সড মিল্ক এর দাম বেড়েছে। বাস ভাড়া, বিদ্যুৎ বিল, গ্যাস বিলও ব্যাপক হারে বেড়েছে। জীবন-যাপনের নানা দিকের ব্যয় অব্যাহতভাবে বাড়লেও সেই হারে আয় কিন্তু মোটেই বাড়েনি বরং বলা যায়, করোনায় গত এক বছরে অধিকাংশ মানুষের আয়ে ব্যাপকভাবে কমেছে। পণ্যের বাজারে শক্তিশালী সিন্ডিকেটের কারণে দাম বাড়ছে বলে সকলের জানা, কিন্তু এই সিন্ডিকেট ভাঙছে না সরকার, নাকি ভাঙতে পারছে না। কার শক্তি বেশি? সিন্ডিকেটের নাকি সরকারের, এমন প্রশ্ন এখন ভোক্তাদের মুখে মুখে। এদিকে আগামী মাসেই আসছে পবিত্র রমজান। এই মাসকে কেন্দ্র করে ইতোমধ্যে অসাধু চক্র মজুদ বাড়াচ্ছে। বিশেষ করে রমজান সংশ্লিষ্ট পণ্যগুলোর বেশি মজুদ করছে এসব অসাধু ব্যবসায়ীরা। টার্গেট, রোজায় বেশি দামে বিক্রি করা। সরকারে যতো বৈঠক করছে, বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখার কথা বলছে বাস্তবে তা তারা পারছেন না। কেনো পারছেন না, এমন প্রশ্নের জবাবে বাজার সংশ্লিষ্টরা ও অভিজ্ঞরা বলছেন, সরকারের অনেক মন্ত্রী ও এমপিরা ব্যবসায়ী, অর্থ্যাৎ বাজার সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে রাখার দায়িত্ব যাদের তারা যখন ব্যবসায়ী, তখন ক্রেতাদের কপালে কি আছে এটা নতুন করে বলার কিছু থাকে না। সময়ে সময়ে সরকারি দপ্তর পণ্যের দাম নির্ধারণ করে দেয়। কিন্তু তা কার্যকর হতে দেখা যায় না খুব একটা। বরং ক্ষেত্রেবিশেষে দাম নির্ধারণের বিষয়টি ব্যবসায়ীদের পক্ষে যায় বলে কেউ কেউ মনে করেন।
দাম বাড়ছে কিন্তু কমছে না
২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর ২০০৯ সালের শুরুতে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। দলটি ক্ষমতায় আসার পরপরই দ্রব্যমূল্য বেড়েই চলছে। আওয়ামী লীগের টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতাগ্রহণের পর গত একযুগে কোনো কোনো পণ্য মূল্য ২শ’ গুণেরও বেশি বেড়েছে। শুধু নিত্যপণ্য নয়, নিত্যব্যবহার্য জিনিসপত্রের দামও বেড়েছে বহুগুণে। সরকারি সেবা কার্যক্রম গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানির দাম বেড়েছে শতভাগেরও বেশি। গত একযুগে বাসাভাড়া কি পরিমাণে বেড়েছে তা তথ্যভিত্তিক পরিসংখ্যান পাওয়া না গেলেও কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) এর এক পরিসংখ্যানে জানা গেছে, ১৯৯০ সাল থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত বাসাভাড়া বেড়েছে ৩২১ দশমিক ১৬ শতাংশ। সেহারে গত একযুগের বাসাভাড়া বৃদ্ধির হার সহজেই আন্দাজ করা যায়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাসা ভাড়া বেড়ে তিনশ’ শতাংশেরও বেশি। অথচ আওয়ামী লীগ ২০০৮ সালে যে নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করেছিল, তাতে দ্রব্য মূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, কিন্তু ক্ষমতায় এসে দলটি সেই প্রতিশ্রুতি রাখেনি। ২০০৮ সালের নির্বাচনের সময় আওয়ামী লীগ নির্বাচনী জনসভায় প্রকশ্যে ঘোষণা করেছিলো দেশের জনগণ ১০ টাকা মূল্যে চাল পাবেন। কিন্তু এখন প্রতিকেজি মোটা চাল ৪৮ থেকে ৫০ টাকা। অর্থ্যাৎ ঘোষণার পাঁচগুণ দামে চাল কিনতে হচ্ছে গরীব-খেটে খাওয়া দিন মজুরদের। আর যারা মধ্যবিত্ত তারা কিনছেন প্রায় ৭ গুণ বেশি দামে। শহর ও গ্রাম, সব পর্যায়ে বেড়েছে চিকিৎসা ব্যয়, সেবাখাতসহ জীবন-যাপনের সব ক্ষেত্রে ব্যয় বাড়লেও সেই হারে মানুষের আয় বাড়েনি। সরকারি চাকুরেদের বেতন বাড়লেও বেসরকারি বা প্রাইভেট পর্যায়ে তুলনামূলকভাবে বেতন বাড়েনি। অন্যদিকে করোনা মহামারির কারণে অনেক মানুষ বেকার ঘরে বসে আছে। যারা কর্মরত রয়েছে তাদের মধ্যে অনেকের বেতন-ভাতা ও অন্যান্য সুবিধাগুলো কমেছে। ফলে মানুষ স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারছে না। কিন্তু মানুষের এ কষ্ট ও দুর্ভোগের দিকে কারো নজর নেই।
জীবন-যাপনে ব্যয় বৃদ্ধির হার
২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার আগে বাসাবাড়িতে ব্যবহৃত গ্যাসের চুলা ১ বার্ণার এর মূল্য ছিল ৩৫০ টাকা। আর দুই বার্ণার এর মূল্য ছিল ৪০০ টাকা। তখন নতুন সরকার ক্ষমতায় আসার পর এক বছরের ব্যবধানে ১ বার্ণার এর গ্যাসের চুলার জন্য মূল্য নির্ধারণ করা হয় ৪০০ টাকা আর ২ বার্ণার এর জন্য নতুন মূল্য নির্ধারণ করা হয় ৪৫০ টাকা। শুধু এক বছরের ব্যবধানে ১ বার্ণারের গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি পায় ১৪ দশমিক ২৯ শতাংশ। ২০২০ সালের ১ জুলাই থেকে কার্যকর হওয়া বাসা বাড়িতে দুই বার্ণার গ্যাসের মূল্য ৯৭৫ টাকা। সেই হিসেবে একযুগে বাসায় গ্যাস ব্যবহারের ক্ষেত্রে মূল্য বেড়েছে ১৪৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ।
বিদ্যুতের দামও বেড়েছে বহুগণ। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার সময় বাসাবাড়িতে বিদ্যুতের ইউনিট প্রতি দাম ছিল ৩ দশমিক ৩৬ টাকা। ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (ডিপিডিসি) এর ২০২০ সালের মার্চ এর মূল্য তালিকা অনুযায়ী তা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে পিক টাইমে ১০ দশমিক ৫০ টাকায়। অর্থ্যাৎ ১২ বছরে নিত্য ব্যবহার্য এই বিদ্যুতের মূল্য বেড়েছে ২১২ শতাংশেরও বেশি। এ অবস্থার মধ্যেও সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতর বিদ্যুতের দাম আরও বাড়ানোর চিন্তা-ভাবনায় রয়েছে। শুধু বাসাবাড়িতেই নয়, অন্যান্য ক্যাটাগরিতে প্রায় কাছাকাছি হারে বেড়েছে বিদ্যুতের মূল্য।
একযুগে অসহনীয় পর্যায়ে বেড়েছে খাদ্যমূল্য। ক্যাব-এর হিসাব মতে ২০০৮ সালে জাতীয় নির্বাচনের বছর গরুর গোশত ছিল প্রতি কেজির গড় দাম ১৯২ দশমিক ৫০ টাকা। ওই সময় এক বছরের ব্যবধানে ২০০৯ সালে তা দাঁড়ায় ২১৮ টাকা। গরুর গোশত এক বছরে ১৩ দশমিক ২৫ শতাংশ দাম বাড়ে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর একযুগে এ গোশতের কেজি মূল্য ৫শ’ ৫০ থেকে (মান ভেদে) ৬শ’ টাকা। গরুর গোশতের বর্তমান মূল্য ৫৫০ টাকা ধরা হলেও ১২ বছরে নিত্যপ্রয়োজনীয় এই পণ্যটির মূল্য বেড়েছে শতকরা ১৮৫ দশমিক ৭১ শতাংশ। ২০০৮ সালে খাসির গোশতের দাম ছিল গড়ে প্রতি কেজি ২৮৩ টাকা ১ যুগের ব্যবধানে এই গোশতের দাম বেড়েছে ১৮২ দশমিক ৬৮ শতাংশ। শুধু গরু বা খাসির গোশতের দামই বাড়েনি, প্রাই একই হারে বেড়েছে মোরগ-মুরগি, হাঁস ও কবুতরসহ অন্যান্য পশু-পাখির গোশতের দামও। দাম বৃদ্ধি হয়নি এমন কোনো পণ্য নেই। হারে কম বেশি হলেও সব পণ্য এমনকি সরকারের সরবরাহকৃত জ¦ালানির দামও বেড়েছে সীমাহীনভাবে।
লবন রান্নার কাজে ব্যবহৃত একটি অনিবার্য উপাদান। এই দুই যুগ আগে এই লবনের কেজি ছিল ‘খোলা’ ২ টাকা। প্যাকেটের লবনের কেজি ছিল ৫ টাকা। আর এক যুগ আগেও (২০০৮ সালে) এই লবণের কেজি ছিল মান ভেদে সর্বোচ্চ ১৪ দশমিক ৫৪ টাকা। ২০০৯ সালে লবনের সর্বোচ্চ মূল্য ছিল ১৪ টাকা। কিন্তু ২০২০-২১ অর্থ বছরের এসে এই একই লবনের দাম ৩৫ থেকে ৪০ টাকা। লবনের বাজার মূল্য গড়ে ২৫ টাকা ধরা হলেও ১২ বছরের ব্যবধানে এই অতি এবং একান্ত প্রয়োজনীয় পণ্যটির মূল্য বেড়েছে শতকরা ১৩৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ।
তথ্যমতে ২০০৯ সালের মার্চ মাসে মিনিকেট চাল বিক্রি হতো ৩২ টাকা কেজি দরে, একই বছরের ডিসেম্বরে একই চাল বিক্রি হয়েছে ৩৮ টাকা কেজি দরে। অর্থ্যাৎ মহাজোট সরকার প্রথম মেয়াদে ক্ষমতা গ্রহণের পর মিনিকেট চালের মূল্য যা ছিল ৯ মাসের ব্যবধানে সেই চাল ভোক্তাদের কিনতে হয়েছিল ১৮ দশমিক ৭৫ শতাংশ বেশি দামে। একই মিনিকেট চাল ১২ বছরের ব্যবধানে বেড়েছে আরো অনেক। ২০০৯ সালে ৩২ টাকা বিক্রি হওয়া মিনিকেট চাল এখন বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৬৪ থেকে মান ভেদে ৭০ টাকা পর্যন্ত। সেক্ষেত্রে এই পণ্যটির মূল্য বেড়েছে ১১৮ দশমিক ৭৫ শতাংশ। প্রায় কাছাকাছি হারেই বেড়েছে- নাজির সাইল, বি আর-১১সহ অন্যান্য চালের মূল্য। অথচ বর্তমান সরকার ২০০৮ সালে নির্বাচনের সময় জনগণকে ১০ টাকা কেজি দরে চাল খাওয়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, মানুষ ওই সময় আওয়ামী লীগের এই নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি বিশ্বাস করলেও ক্ষমতায় এসে সরকার জনগণের সেই বিশ্বাস ভঙ্গ করেছে বলে অভিযোগ করছেন বিরোধীরা।
সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস
গত বারো বছরে পণ্যের বাজাওে যা কিছু হয়েছে সেগুলো ভোক্তারা অনেক কষ্টে কোনো কোনোভাবে সামাল দিতে সক্ষম হলে এখন যেন কিছুতেই পেরে উঠছে না। প্রত্যেক অপরিহার্য পণ্যেও দামই হু হু করে বাড়ছে। অন্যদিকে গত এক বছরে মানুষের ক্রয় ক্ষমতা অনেক কমে গেছে। অনেকে হঠাৎ বেকার হয়ে পড়েছেন, আবার অনেকের আয়, এমনকি নির্ধারিত বেতন-ভাতাও কমে যাওয়ার নজির সৃষ্টি হয়েছে ব্যাপকভাবে। যা অতীতে কখনো কল্পনাই করা যেতো না। তেমন একটা পরিস্থিতিতে ক্রেতার উপর ঘাঁ হয়ে দেখা দিয়েছে পণ্যমূল্যের এই অস্বাভাবিক বৃদ্ধি। বিশেষ করে নিম্ন আয়ের মানুষ পড়েছে চরম বিপাকে। চাকরি চলে যাওয়া বা আয় কমে যাওয়া মধ্যবিত্তেরর এখন অনেকটা মরণদশা বলা যায়।
মন্ত্রণালয়ের ব্যর্থতায় পকেট কাটছে ভোক্তার
বাজারে অস্বাভাবিক মুল্য বৃদ্ধি হলে তা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব সরকারের। বিশেষ করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বাজার নিয়ন্ত্রণ ও দ্রব্যমূল্য মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে রাখার দায়িত্বে রয়েছে। আর খাদ্য উৎপাদন ব্যাহত হলে বা খাদ্য সঙ্কট দেখা দেওয়ার আশঙ্কা তৈরি হলে খাদ্য মন্ত্রণালয় সম্ভাব্য সঙ্কট থেকে উত্তোরণের পথ খুঁজতে মরিয়া হয়ে উঠবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু দেশের ২০ থেকে ২৫টি জেলায় টানা বানের পানি থাকায় খাদ্য উৎপাদন কমে হয়েছে বলে সরকারের তরফ থেকে দাবি করা হয়। আর এ কারণে অভ্যন্তরীণ উৎপাদন থেকে খাদ্য সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি। কিন্তু বিদেশের বাজার থেকে প্রয়োজনীয় খাদ্য সংগ্রহে রাখার দায়িত্বও সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় যথাযথভাবে পালন করেনি বলেই খাদ্যভান্ডারে সঙ্কট রয়েছে। অন্যদিকে বাজার নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে থাকা বাণিজ্য মন্ত্রণালয় নাকে তেল দিয়ে ঘুমিয়েছে। এ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা মন্ত্রীকে অন্তত এক মাসের মধ্যে দেশের কোনো বাজার পরদর্শনে দেখা গেছে এমন কোনো ভিডিও বা স্থিরচিত্র গণমাধ্যমে এসেছে কিনা সন্দেহ। তিনি শুধু বৈঠক করছেন নির্দেশনা দিচ্ছেন, আশ^াস্ত করছেন। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই করছেন না। ফলে মন্ত্রীর নির্দেশনা ও আহ্বানকে ‘সোনাভানুর পুথির’ মতো ব্যবসায়ীরা এক কান দিয়ে শুনছেন আর অন্য কান দিয়ে বের করে দিচ্ছেন। মন্ত্রী ও মন্ত্রণালয়ের সীমাহীন ব্যর্থতার কারণে একদিকে যেমন তৈরি হচ্ছে খাদ্য সঙ্কট, অন্য দিকে পাগলা গোড়ার মতো ছুটছে বাজার দর। আর পকেট কাটছে সাধারণ মানুষদের। তারা প্রতিবাদও করতে পারছেন না আর ক্রয় ক্ষমতা না থাকার কারণে অপরিহার্য পণ্যও কিনতে পারছেন না, চরম কষ্টে শুধু হাপিত্যেশ করছেন।
এখন দাম বাড়ছে হু হু করে
অনেক পণ্যের ক্ষেত্রে গতকালের চাইতে আজ, আজকের চাইতে আগামী দিন মূল্য বাড়ছে। এখন দাম বাড়ছে হু হু করে। বিশেষ করে নিত্যপণ্যের মূল্য বাড়ছেই। এক সপ্তাহ আগে যে পেঁয়াজের দাম ছিল প্রতিকেজি ৩০ টাকা। মাত্র ৭ দিনের ব্যবধানে সেই পেঁয়াজ কেজি প্রতি ২০ টাকা বেড়েছে। অথচ সরকারি-বেসরকারি উভয় হিসাবেই বাজারে এখন পেঁয়াজের কোনো সংকট নেই। চাহিদা অনুযায়ী পর্যাপ্ত পরিমাণে পেঁয়াজ বাজারে আছে। ক’দিন আগেও (দেড় মাস) কক (সোনালিকা) মুরগীর কেজি ছিল ১৬০ থেকে ১৭০ টাকা। এখন একই মুরগী প্রায় এক মাস ধরে বিক্রি হচ্ছে ২৫০ থেকে ২৬০ টাকা। ফলে অনেকে এখন আর এ জাতের মুরগী কিনতে পারছেন না। ভর করছেন ব্রয়লারের ওপর। এদিকে ব্রয়লার মুরগীর কেজি মূল্য ছিল ১০০ থেকে ১১০ টাকা। এখন সেই ব্রয়লার মুরগীর কেজি মূল্য ১৫৫ থেকে ১৬০ টাকা পর্যন্ত। প্রায় একই অবস্থা অন্য অনেক পণ্যে। ফলে অনেক ক্রেতা বাজারে আসর আগে যে পণ্য কিনার পরিকল্পনা করে আসেন। যাওয়ার সময় তা না কিনেই চলে যাচ্ছেন।
শুধু মুরগী নয়, বাজারে সরু বা চিকন চালের দাম কেজিতে বেড়েছে ১-২ টাকা। গত সপ্তাহে যে চাল ৬২ টাকা ছিল, সেই চাল বিক্রি হচ্ছে ৬৪ টাকা দরে। বাজারে আসতে শুরু করা গ্রীষ্মের আগাম সবজির দাম চড়া। পটল ও ঢেঁড়সের দাম প্রতি কেজি ৮০-১০০ টাকা। এছাড়া লেবু ৫০-৬০ টাকা হালি, শসার কেজি বিক্রি হচ্ছে ৩০ থেকে ৪০ টাকার মধ্যে। শিমের কেজি বিক্রি হচ্ছে ৩০ থেকে ৪০ টাকা। এছাড়া মুলার কেজি বিক্রি হচ্ছে ২০ থেকে ২৫ টাকা, বেগুনের কেজি ৩০ থেকে ৪০ টাকা, পেঁপের কেজি ৩০ থেকে ৩৫ টাকা, গাজরের কেজি ২৫ থেকে ৩০ টাকা বিক্রি হচ্ছে। বাজারে এক ডজন লাল ডিম বিক্রি হচ্ছে ৯০ টাকায়, হাঁসের ডিম ১৫৫ থেকে ১৬০ টাকা, দেশি মুরগির ডিমের ডজন ১৯৫ থেকে ২০০ টাকা বিক্রি হচ্ছে। আগের মতো এ সপ্তাহেও গরুর মাংস ৫৮০ থেকে ৬০০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। আর খাসির মাংস ৮৮৫০ থেকে ৯০০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। রাজধানীর বাজারগুলোতে আকার ভেদে শিং মাছ বিক্রি হচ্ছে ২৫০ থেকে ৩৫০ টাকা কেজিতে, রুই ২২০ থেকে ৩০০ টাকা, পাঙাস ৯০ থেকে ১৫০ টাকা, কাতলা ২০০ থেকে ২৫০ টাকা, তেলাপিয়া ১০০ থেকে ১৫০ টাকা, কৈ ১০০ থেকে ১৫০ টাকা, মলা মাছ ২৩০ থেকে ২৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
ভোজ্যতেলের অস্বাভাবিক দাম বাড়ার প্রেক্ষিতে খুচরা, পাইকারি ও মিলগেট পর্যায়ে সয়াবিন ও পামসুপার তেলের দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে সরকার। কিন্তু খবর নিয়ে জানা গেছে, সরকার দর ঠিক করে দিলেও সেই দরে সয়াবিন তেল বা পামসুপার তেল পাওয়া যাচ্ছে না। সরকার তথা বাণিজ্য মন্ত্রণালয় গত ১৭ ফেব্রুয়ারি প্রতি লিটার সয়াবিন (খোলা) মিলগেটে ১০৭ টাকা, পরিবেশক মূল্য ১১০ টাকা এবং খুচরা মূল্য ১১৫ টাকা নির্ধারণ করে দেয়। বোতলের প্রতি লিটার সয়াবিন মিলগেট মূল্য ১২৩ টাকা, পরিবেশক মূল্য ১২৭ টাকা এবং খুচরা মূল্য ১৩৫ টাকা নির্ধারণ করে দিয়েছে। আর বোতলের ৫ লিটার সয়াবিন মিলগেট মূল্য ৫৮৫ টাকা, পরিবেশক মূল্য ৬০০ টাকা এবং খুচরা মূল্য ৬৩০ টাকা নির্ধারণ করে দিয়েছে। সেই সঙ্গে পাম সুপারের প্রতি লিটার মিলগেট মূল্য (খোলা) ৯৫ টাকা, পরিবেশক মূল্য ৯৮ এবং খুচরা বাজারে ১০৪ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে খবর নিয়ে ‘ভোজ্যতেলের দরের ক্ষেত্রে অস্থিরতা ও অরাজকতা’ দেখা গেছে। অধিকাংশ বাজার বা দোকানেই সরকার নির্ধারিত দরে ভোজ্যতেল বা সয়াবিন তেল পাওয়া যাচ্ছে না। বাজার ঘুরে দেখা গেছে, খুচরা পর্যায়ে খোলা সয়াবিন তেল ১১৫ টাকা দরে বিক্রি করার কথা থাকলেও বিক্রি হচ্ছে ১৩৫ টাকায়। একইভাবে পামসুপার বিক্রি হচ্ছে ১২৫ টাকায়। যা বিক্রি করার কথা প্রতিলিটার ১০৪ টাকা। বোতলের ৫ লিটার সয়াবিন তেল ৬৩০ টাকায় বিক্রি করার কথা থাকলেও তা বিক্রি হচ্ছে ৬৭০ টাকার ওপরে। ১৩৫ টাকা বোতলে এক লিটার সয়াবিন পাওয়া গেলেও কোনও কোনও কোম্পানির বোতলের এক লিটার সয়াবিন বিক্রি হচ্ছে ১৪০ টাকায়।
আসছে রোজা
রোজার সময় যতো কাছাকাছি হয়, পণ্যমূল্য ততো বাড়তে থাকে। ভুক্তভোগীরা বলছেন, রোজা আসার প্রায় তিন আগ থেকেই অসাধু ব্যবসায়ীরা কারসাজির পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। অবৈধভাবে বাড়ায় মজুদ। সৃষ্টি করে কৃত্রিম সঙ্কট। বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রতি বছর রমজান এলেই জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যায়। এমনকি কিছু পণ্যের দাম ক্রেতার নাগালের বাইরে চলে যায়। অসাধু ব্যবসায়ীরা যেন ওঁৎপেতে থাকেন এ মাসের জন্য। এসব অসাধু ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে একাধিক বৈঠক করে সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরগুলো। কঠোর হুঁশিয়ারিও দেওয়া হয়, নেওয়া হয় নানা উদ্যোগও। কিন্তু অসাধু ব্যবসায়ীরা খুবই শক্তিমান, তারা সব সময়ই থাকেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। সরকারের পক্ষ থেকে রোজায় বাজার নিয়ন্ত্রণের হাকডাক দেওয়া হলেও বাজার অনিয়ন্ত্রিতই থাকে প্রতিবার। বাজার নিয়ন্ত্রণের পদক্ষেপ-প্রতিশ্রুতিগুলো কাগজে-কলমেই থেকে যায়। বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, সর্বশেষ গত বছর রমজানে সরকারের পক্ষ থেকে দাম বাড়বে না- এমন প্রতিশ্রুতির পরও প্রতি কেজি ছোলা ৫-৮ টাকা, মসুর ডাল ২০-২৫ টাকা, পেঁয়াজ ১০-১৫ টাকা, চিনি, ৫-৬ টাকা, গরুর গোশত ৫০-১০০ টাকা ও ব্রয়লার মুরগি কেজিতে ১০ টাকা বাড়তি দরে বিক্রি হয়েছে। এছাড়া ফল এবং সবজিও বেশি দামে বিক্রি হয়েছে।
এবার আগামী ১৪ এপ্রিল পবিত্র রমজান শুরুর সম্ভাবনা রয়েছে। এরই মধ্যে নিত্যপণ্যের বাজার বেসামাল হতে শুরু করেছে। প্রতি বছরই রোজার আগে দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে বৈঠক করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে। এবার প্রতিমন্ত্রী আগে থেকেই বলেছেন, পর্যাপ্ত মজুত আছে, রোজায় পণ্যের কোনো সঙ্কট দেখা দেবে না। কিন্তু মন্ত্রীর এমন বক্তব্যের সঙ্গে বাস্তবতার কোনো মিল খুঁজে পাচ্ছে না ক্রেতা সাধারণ। পণ্যের মজুত পর্যাপ্ত থাকলে রোজার আগেই কেন বাজার এতো অস্থিতিশীল? আর এ কারণেই রোজাকে কেন্দ্র করে সাধারণ মানুষের আশংকা বাড়ছে।
Leave a Reply