করোনা মহামারির মধ্যেও ২০২০ সালে দেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি উদ্বেগজনক বলে জানিয়েছে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)। অব্যাহত ছিল বিভিন্ন বাহিনী কর্তৃক বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনা।
এ সময়ে ৩০০টি বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনা ঘটেছে বলে প্রতিবেদনে জানানো হয়। যার মধ্যে ক্রসফায়ারে মৃত্যু ১৮৮ জন এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মাদকবিরোধী অভিযানে নিহত ১১২ জন।
বৃহস্পতিবার অনলাইনে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি ২০২০-এর পর্যালোচনা-বিষয়ক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানানো হয়। দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও প্রচারিত সংবাদের এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনার বিষয়ে আসকের তথ্যানুসন্ধানের ভিত্তিতে এই প্রতিবেদন তৈরি করা হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা আগের বছরগুলোকে ছাড়িয়ে গেছে। বছর জুড়ে ধর্ষণ, দলবদ্ধ ধর্ষণ, ধর্ষণ পরবর্তী হত্যাসহ, যৌন হয়রানি, পারিবারিক নির্যাতনের ঘটনা প্রতিনিয়তই ঘটেছে।
দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির সার্বিক দিক তুলে ধরতে বেশ কয়েক ভাগে ভাগ করে প্রতিবেদনটি তুলে ধরে আসক।
বিচারবহির্ভূত হত্যা ও নির্যাতন :
ক্রসফায়ার ও মাদকবিরোধী অভিযানে ৩০০ জন নিহতের ঘটনা ছাড়াও বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে (গ্রেপ্তারের পর) নিহত হয়েছেন ১১ জন। গ্রেপ্তারের আগে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নির্যাতনে মারা যান পাঁচ জন এবং গুলিতে নিহত হয়েছেন আট জন।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে অপহরণ ও গুম :
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে অপহরণ, গুম ও নিখোঁজের শিকার হন ছয় জন।
ধর্ষণ :
২০২০ সালে সারা দেশে ধর্ষণ ও সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ১ হাজার ৬২৭ নারী। এর মধ্যে ধর্ষণ-পরবর্তী হত্যার শিকার হয়েছেন ৫৩ জন এবং ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছেন ১৪ জন। ২০১৯ সালে ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন ১৪১৩ নারী এবং ২০১৮ সালে এই সংখ্যা ছিল ৭৩২।
পারিবারিক নির্যাতন ও যৌতুক :
পারিবারিক নির্যাতনের কারণে মারা গেছেন ৩৬৭ নারী। নির্যাতনের শিকার ৯০ জন আত্মহত্যা করেছেন। যেখানে গত বছর অর্থাত্ ২০১৯ সালে পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন ৪২৩ নারী। এছাড়া যৌতুকের জন্য, সালিশের মাধ্যমে নির্যাতন, গৃহকর্মী নির্যাতন ও অ্যাসিড নিক্ষেপের ঘটনাও ঘটেছে।
শিশু নির্যাতন :
শারীরিক নির্যাতন, ধর্ষণ, হত্যাসহ বিভিন্ন কারণে ৫৮৯ শিশু নিহত হয়েছে। ২০১৯ সালে এ সংখ্যা ছিল ৪৮৮। ২০২০ সালে বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হয় ১৭১৮ শিশু। এর মধ্যে ধর্ষণের শিকার হয় ১০১৮ শিশু, ধর্ষণচেষ্টা ও যৌন হয়রানির শিকার হয় ২৭৯ শিশু। ২০২০ সালে বলাত্কারের শিকার হয়েছে ৫২ ছেলে শিশু, বলাত্কারের পর ৩ শিশুর মৃত্যু হয়েছে বলে জানায় আসক।
মতপ্রকাশের অধিকার :
করোনাকালে মতপ্রকাশের অধিকার খর্ব করাসহ দমনপীড়ন বেড়েছে বলে জানিয়েছে আসক। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ১২৯টি মামলা হয়েছে এবং এসব মামলায় ২৬৮ জনকে আসামি করা হয়েছে।
সাংবাদিক নির্যাতন :
বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ২৪৭ সাংবাদিক। তার মধ্যে দুজন হত্যার শিকার হয়েছেন।
সভা-সমাবেশে বাধা :
শান্তিপূর্ণভাবে সভা-সমাবেশ করা ও প্রতিবাদ জানানো নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার, যা বিভিন্ন মানবাধিকার দলিলেও সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে। তা সত্ত্বেও বাংলাদেশে ধারাবাহিকভাবে এ ধরনের ঘটনা ঘটে চলেছে বলে জানায় আসক। বিএনপি, বাম জোটভুক্ত দলগুলোর সভা-সমাবেশসহ নানা কর্মসূচিতে বাধার অভিযোগ আছে। এছাড়াও জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে আন্দোলনরত তাজরীন ফ্যাশনস লিমিটেডের শ্রমিক এবং স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসা শিক্ষকদের গত ৭ ডিসেম্বর ভোর রাতে ঘুম থেকে তুলে লাঠিপেটা করে উঠিয়ে দেয় পুলিশ।
স্বাস্থ্য অধিকার :
করোনা সংক্রমণকালে দেশের স্বাস্থ্য খাতের বিদ্যমান নানা অনিয়ম, দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার চিত্র গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরস্পরকে দোষারোপ করার মতো ঘটনাও ঘটে ২০২০ সালে।
শ্রমিক অধিকার :
করোনা সংকটকালীন সময়ে শ্রমিকদের চাকরি হারানো, বেতন না পাওয়াসহ নানা বঞ্চনার ঘটনা ঘটেছে। এ সময়ের মধ্যে গার্মেন্টশিল্পের ৬০ থেকে ৬৫ হাজার শ্রমিক ছাঁটাইয়ের শিকার হয়েছেন এবং ছাঁটাইকৃত শ্রমিকদের পাওনা পরিশোধ করা হয়নি। করোনা ভাইরাসের সংক্রমণরোধে সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হলেও ছুটি পাননি চা শ্রমিকরা।
এছাড়া সীমান্ত হত্যা, করোনাকালে দেশে ফেরা অভিবাসী শ্রমিকদের হয়রানি, সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর ওপর হামলা, নির্যাতন, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়েও উদ্বেগের কথা জানায় সংস্থাটি।
Leave a Reply