করোনাভাইরাস মহামারীকালেও স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতি-অনিয়ম থেমে থাকেনি। বরং বিদ্যমান দুর্নীতি ও নতুনভাবে সংগঠিত দুর্নীতির উন্মোচন ঘটেছে বলে জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।
আইনের শাসনের ঘাটতি ছাড়াও চিকিৎসা ও সুরক্ষাসামগ্রী ক্রয়, নমুনা পরীক্ষা, চিকিৎসাসেবা, ত্রাণ বিতরণে দুর্নীতিসহ বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতি পেয়েছে সংস্থাটি। উলেখিত সংকট মোকাবেলায় ১৫ দফা সুপারিশও করা হয়।
মঙ্গলবার ‘করোনাভাইরাস সংকট মোকাবেলায় সুশাসনের চ্যালেঞ্জ : দ্বিতীয় পর্ব’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে টিআইবি এসব তথ্য তুলে ধরে। পরিসংখ্যান পদ্ধতি ব্যবহার করে অনলাইন ও টেলিফোন জরিপের মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ, ত্রাণ ও সামাজিক নিরাপত্তা এবং স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান সম্পর্কিত তথ্য সংগ্রহ করে গবেষণা করা হয়। টিআইবি জানায়, তথ্য প্রকাশে বিধিনিষেধ আরোপের মাধ্যমেও অনিয়ম-দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনাকে আড়াল করার প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, নির্বাহী ব্যবস্থাপনা উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের, গবেষণা ও পলিসি বিভাগের সিনিয়র প্রোগ্রাম ম্যানেজার শাহজাদা এম আকরাম। গবেষণা ও পলিসি বিভাগের ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার মো. জুলকারনাইন প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন এবং অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন আউটরিচ ও কমিউনিকেশন বিভাগের পরিচালক শেখ মঞ্জুর-ই-আলম।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, করোনাভাইরাস মোকাবেলায় প্রাক-সংক্রমণ প্রস্তুতিমূলক পর্যায় এবং সংক্রমণকালে সরকারের গৃহীত বিভিন্ন কার্যক্রম বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সুশাসনের চ্যালেঞ্জ চিহ্নিত করার উদ্দেশ্যে ১৫ জুন একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল টিআইবি। এর ধারাবাহিকতায় করোনা মোকাবেলায় সরকারের গৃহীত বিভিন্ন কার্যক্রম বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বিদ্যমান সুশাসনের চ্যালেঞ্জ চিহ্নিত করার উদ্দেশ্যে ১৬ জুন থেকে ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত সংগৃহীত তথ্য বিশ্লেষণের মাধ্যমে গবেষণাটি পরিচালিত হয়।
ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, করোনাসংকট মোকাবেলায় জাতীয় ও স্থানীয় উভয় পর্যায়ে সুশাসনের সবগুলো নির্দেশের ব্যত্যয় ঘটেছে এবং ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে। ঘাটতি বা ব্যত্যয়গুলোর অধিকাংশ মানবসৃষ্ট। করোনা সংকট এবং এ সংকট মোকাবেলার ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য খাত যে চাপের মধ্যে পড়েছে তাতে দুর্নীতিবাজ, দুর্নীতির সুবিধাভোগী এবং দুর্নীতিতে নিমজ্জিত ব্যক্তিরা দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েছে। এ ক্ষেত্রে কোনো জবাবদিহিতা ছিল না। নিয়ন্ত্রণ ও তদারকি ছিল না বললেই চলে। দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের নামে কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিভাগীয় পদক্ষেপের অংশ হিসেবে শুধু বদলি ও ওএসডি-নির্ভর একধরনের আনুষ্ঠানিকতা দেখা গেছে। কিন্তু দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির কোনো নমুনা দেখা যায়নি। দুদক কিছুটা সক্রিয় হলেও একধরনের সীমারেখার ভেতরে তারা বিচরণ করছে। ফলে যারা দুর্নীতির তথাকথিত রুই-কাতলা তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে, শুধু সামনের সারিতে থাকা কিছু ব্যক্তিকে টানাহেঁচড়া করা হয়েছে। এ সময় স্বাস্থ্যবিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটি একটি বৈঠকও করেনি। তারা সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় ছিল।
করোনা সংকটে তথ্যের নিয়ন্ত্রণে উদ্বেগ প্রকাশ করে ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, আমরা শুরু থেকে দেখতে পাই সরকার করোনা মোকাবেলার বদলে এ সংক্রান্ত কার্যক্রম নিজ নিয়ন্ত্রণে রাখার বিষয়টিকে বেশি প্রাধান্য দিয়েছে। এক ধরনের সংকোচনমূলক নীতি অবলম্বন করা হয়েছে। ফলে তথ্য ও পরীক্ষা নিয়ন্ত্রিত হয়েছে এবং স্বাস্থ্য খাতে জনগণের অভিগম্যতা কমে গেছে। শনাক্তের সংখ্যা উদ্দেশ্যমূলকভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখা হয়েছে। এর মাধ্যমে রাজনৈতিক সাফল্যের দৃষ্টান্ত হিসেবে ব্যবহারের প্রবণতা দেখা গেছে। দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের চেয়ে সরকারের বেশি তৎপরতা ছিল তথ্যের প্রকাশ নিয়ন্ত্রণে। যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক এবং আমাদের সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। শীত মৌসুমে করোনা সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী সতর্কবার্তা দিলেও বাস্তবে বিক্ষিপ্ত কিছু ঘোষণা ছাড়া করোনা মোকাবেলার বিষয়ে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা বা কৌশল দেখতে পাওয়া যায়নি।
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, করোনাকালে প্রাসঙ্গিক আইন অনুসরণে ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়। এ সংক্রান্ত দুটি আইনও যথাযথভাবে মানা হয়নি। এছাড়া করোনা মোকাবেলায় স্বাস্থ্য খাতে বিদেশি অর্থায়নে পরিচালিত প্রকল্পসহ বিভিন্ন জিনিস ক্রয়ে পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালা (পিপিআর) ২০০৮ অনুসরণের ক্ষেত্রেও ঘাটতি লক্ষ্য করা যায়। এসব দূর করতে ১৫টি সুপারিশ করেছে টিআইবি। এগুলো হল- এক. স্বাস্থ্যখাতের সব ধরনের ক্রয়ে সরকারি ক্রয় আইন ও বিধি অনুসরণ করা। জরুরিসহ সব ক্রয় ই-জিপিতে করা। দুই. করোনা সংক্রমণের সম্ভাব্য দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবেলায় বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা করা। তিন. বিনামূল্যে নমুনা পরীক্ষার সুবিধা সব জেলায় সম্প্রসারণ করা, নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা বাড়ানো। চার. স্বাস্থ্যসুরক্ষা সামগ্রীসহ চিকিৎসা বর্জ্যরে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা; সংশ্লিষ্ট স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। পাঁচ. সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার মাধ্যমে প্রয়োজনে বেসরকারি হাসপাতালের সেবাগুলোকে (আইসিইউ, ভেন্টিলেটর ইত্যাদি) করোনা চিকিৎসা ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত করা। ছয়. বিশেষজ্ঞ কমিটির সুপারিশ গ্রহণ ও বাস্তবায়নে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সরকারি দফতরের মধ্যে সমন্বয় বাড়ানো। সাত. দেশজুড়ে প্রান্তিক ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে সহযোগিতার জন্য সরকারি বিভিন্ন কার্যক্রমের পাশাপাশি বেসরকারি উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা। আট. সংসদীয় স্থায়ী কমিটির নিয়মিত সভা করা এবং অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া। নয়. করোনা সংক্রান্ত তথ্য প্রকাশের বিধি-নিষেধ বাতিল করা। ১০. গণমাধ্যমসহ বিভিন্নভাবে সরকারি ক্রয়, করোনা সংক্রমণের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ, ত্রাণ ও প্রণোদনা বরাদ্দ ও বিতরণ ইত্যাদি বিষয়ে অবাধ তথ্য প্রবাহ নিশ্চিত করা। ১১. ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল বা সংশোধন করা এবং হয়রানিমূলক সব মামলা তুলে নেয়া। ১২. বিভিন্ন সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির উপকারভোগীদের তালিকা যাচাই-বাছাই ও হালনাগাদ করা এবং ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা। ১৩. স্বাস্থ্য খাতের ক্রয়ে তদারকি বাড়ানো এবং অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া। ১৪. সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রম প্রক্রিয়ায় অনিয়ম ও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত এবং সাময়িক বরখাস্ত জনপ্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় তথ্য-প্রমাণসহ মামলা করা। পরবর্তী যে কোনো নির্বাচনে তাদের অংশ নেয়ার সুযোগ ও যোগ্যতা বাতিল ঘোষণা করা এবং ১৫. সম্মুখসারির সব স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রাপ্য প্রণোদনা দ্রুত বিতরণের ব্যবস্থা করা।
এছাড়া গবেষণাপত্রে বেশকিছু খাতে অনিয়মের কথা উলেখ করা হয়। উল্লেখযোগ্য বিষয়গুলোর মধ্যে রয়েছে- পরীক্ষাগার ও নমুনা পরীক্ষা সম্প্রসারণে ঘাটতি, পরিকল্পনা ও কৌশল প্রণয়নে ঘাটতি, চিকিৎসা ব্যবস্থায় সক্ষমতার ঘাটতি, ক্রয় সংক্রান্ত তথ্য প্রকাশে ঘাটতি, সরকারি ক্রয়ে দুর্নীতি, নমুনা পরীক্ষায় দুর্নীতি এবং সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি।
Leave a Reply